এই মুহূর্তে




১৯৯ বছরের মতিলাল শীল বাড়ির পুজো আজও সর্ব-সাধারণের




নিজস্ব প্রতিনিধি: বনেদি রাজবাড়ির পুজো হলেও তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। কারণ প্রায় ২০০ বছর আগে মতিলাল শীল তাঁর বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনাই করেছিল সর্বসাধারণকে পুজো দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে। আঠারো শতকের সেই সময়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গোৎসবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল শহর, গ্রাম-বাংলা ছাড়িয়ে বিদেশেও। রাজবাড়ির পুজো মানে রাজকীয় আয়োজন, সাহেব আর উচ্চবর্ণের মানুষের আনাগোনা। সাধারণ মানুষের সেখানে কোনও জায়গাই ছিল না। এমন কথা শোনামাত্রই কলুটোলার বাড়িতে দুর্গাপুজো করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন ধনাঢ্য জমিদার মতিলাল শীল। কারণ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে তাঁকেও লড়তে হয়েছিল চরম অভাব-অনটনের সঙ্গে।

কম বয়সে পিতৃহারা মতিলাল ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বুদ্ধিমান এবং করিৎকর্মা। হয়তো সে কারণেই সে সময় এমন কোনও ব্যবসা ছিল না, যাতে মতিলাল শীল বিনিয়োগ করেননি। কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল ১৮১৫ সালে। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করার বরাত পেয়েছিলেন তিনি। নীল, চিনি, কাপড় ও চাল তাঁর মতো পরখ করতে পারেন, এমন কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি শহর কলকাতায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। যে কারণে বেশ কিছু বিদেশি এজেন্সি তাঁকে ‘বেনিয়ান’ হিসাবে নিয়োগ করেছিল। এরপর একে একে হাওড়া, কলকাতা, বাগনান, মেদিনীপুর, বাংলাদেশ, ভাগলপুর-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারি বিস্তার করেছিলেন মতিলাল শীল।

তবে শুধু অর্থ আয় আর প্রতিপত্তি বিস্তারেই থেমে থাকেননি মতিলাল। সমাজিক কাজেও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উন্নতিকল্পে মতিলাল শীল ১২ হাজার টাকা দান করেন। হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের নামকরণ করা হয়েছিল মতিলাল শীল ওয়ার্ড। সমাজ সংস্কারেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তখন বিধবা বিবাহ এবং সতীদাহ নিয়ে উত্তাল ছিল বাংলা। রাধাকান্ত দেব এবং রামমোহন রায়ের দলের মধ্যে যখন চূড়ান্ত আদর্শগত বিরোধ চলছে। সেই সময় নিজে ধর্মসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বিধবা বিবাহের উপযোগিতা নিয়ে সরব হয়েছিলেন মতিলাল শীল।

শীল বাড়িতে বরাবরই পুজো হয়ে আসছে একচালার প্রতিমা, দুর্গার বাহন সাদা সিংহ।  এখন বাড়ির পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন মল্লিকরা। মতিলাল শীলের মূল বসতবাড়ি তাঁর ছোটছেলে কানাইলাল শীলের ভাগে পড়েছিল। কিন্তু তাঁর পুত্র গোপাললালের কোনও সন্তান না থাকায় ভাগ্নেরা এই বাড়ি পান। তাঁরাই বর্তমানে পালা করে পুজো করেন। আজও রীতি মেনেই উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে শুরু হয় পুজো। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। সপ্তমীর দিন সকালে মতিলাল শীল ঘাটে কলাবউ স্নানের পর বাড়ির কুলদেবতা লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তিকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। অষ্টমীর দিন সকালে বাড়ির মেয়েরা ঠাকুরের সামনে ধুনো পোড়ান। সন্ধিপুজোয় ঠাকুরের সামনে দেওয়া হয় একমণ চালের নৈবেদ্য। মাটিতে কলাপাতা পেতে তার ওপর নৈবেদ্য দিয়ে চারিদিকে মালসা সাজিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও পুজোর প্রতিটি দিন ২৮টি পাত্রে একমণ করে চাল কলা মিষ্টি-সহ নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ায় শীলবাড়ির পুজোতে বলির নিয়ম নেই। তবে আজও আখ, চাল-কুমরো, বাতাবি লেবু বলির জন্য সাজিয়ে পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানে দিয়ে দেওয়া হয়।

শীল বাড়িতে অন্নভোগ হয় না। পঞ্চমীর দিন থেকে ভিয়েন বসিয়ে দরবেশ, লেডিকেনি, মালপোয়া, গজা, নারকেল নাড়ু আর নোনতার মধ্যে কচুরি, সিঙ্গারা, নিমকি তৈরি করাহয়। সেগুলিই ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়। পুজোর দিনগুলিতে ঠাকুরদালানের উল্টোদিকে দোতলা ঘরে বসত বাঈনাচের আসর। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিনদিন যাত্রা হত। নিমাই সন্ন্যাস খুবই জনপ্রিয় যাত্রাপালা ছিল সেই সময়। প্রায় প্রত্যেক পুজোতেই নিমাই সন্ন্যাস হত। এখন অবশ্য সেইসব কিছুই নেই। মহানবমীর দিন রাতে ব্রাহ্মণ-বিদায় হয় ঘটা করে। আগে প্রায় দেড়শো জন ব্রাহ্মণকে নানা দানসামগ্রী, সুপুড়ি আর টাকা দিয়ে ব্রাহ্মণ-বিদায় করা হত। এখন দশ-বারো জন মাত্র ব্রাহ্মণ আসেন ব্রাক্ষণ বিদায়ের জন্য। শীলবাড়িতে সিঁদুর খেলায় অত ঘটা হয় না।

মতিলাল শীলের বাড়ির ঠাকুর ১৯৪৫ সাল অবধি কাঁধে করে বিসর্জন হত। তবে ৪৬-এর দাঙ্গায় সেই নিয়ম পাল্টে যায়। ওইবছর বাড়ির মূল দরজা বন্ধ রেখে বাইরে সশস্ত্র পুলিশ বসিয়ে পুজো সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু ঠাকুর আর কাঁধে করে পাঠানো যায়নি গঙ্গায়। এখন অবশ্য গাড়ি করেই গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বিসর্জন নয় মতিলাল শীল বাড়ির একচালার মূর্তি।

Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

৩০০ বছর ধরে সিংহবাহিনী দেবী রূপে পুজিতা হয়ে আসছেন এই রাজবাড়িতে

দশভুজা রূপে নন, দেবী এখানে পুজিতা হন ‘দুই’ হাতেই

বেলগাছকে দুর্গা রূপে পুজো, আজও বলির নিয়ম চলে আসছে শীল বাড়িতে

মায়ের স্বপ্নাদেশে শুরু পুজো! দেবীর আট হাত ঢেকে রাখা হয় এই বনেদি বাড়ির পুজোয়

ঘটি-বাঙালের মিশ্রণ, এই বনেদি পুজোয় বাড়ির পান্তা খেয়ে বিসর্জনের রীতি আজও রয়েছে

বারাসতের দক্ষিণপাড়ায় ৪৫৪ বছরের শিবের কোঠার দুর্গাপুজো সংকল্পিত হয় যোধাবাঈয়ের নামে

Advertisement
এক ঝলকে
Advertisement

জেলা ভিত্তিক সংবাদ