নিজস্ব প্রতিনিধি: দুর্গা নয়, বরং পুজো করা হয় অসুরকে। পুজো এলেই জঙ্গলমহলে আলোচনায় উঠে আসে অসুর সম্প্রদায়ের নাম। একটা সময় পর্যন্ত তারা দুর্গাপুজোয় অংশ নিত না। অসুর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, মহিষাসুর তাঁদের পূর্বপুরুষ। তাই পূর্বপুরুষের হত্যাকারিণী দুর্গার মুখ দর্শন করা নিষেধ তাঁদের। বরং অসুর পুজো করেন তাঁরা। পুজোর ক’দিন বাড়ির চারপাশ কালো কাপড়ে ঘিরে রাখেন শোকের চিহ্ন হিসেবে, একইসঙ্গে যাতে পুজোয় ঢাকের বোল ও মন্ত্রচ্চারণ শোনা না যায় সেজন্যই। তবে যতই দিন যাচ্ছে ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে ছবিটাও। খেলতে খেলতে সঙ্গীদের হাত ধরে পুজো মণ্ডপে পা রাখছে খুদেরা।
ঝাড়গ্রামের সোনাকুন্দরা গ্রামে ষষ্ঠীর দিন পূর্বাঞ্চল আদিবাসী কুড়মি সমাজ এই অসুর স্মরণ উত্সব পালন করে। মূলত, আদিবাসী ও আদি জনজাতিরাই এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই এলাকায় সংস্কৃতির সুপ্ত সংঘাত ছিলই, আদিবাসীরা নিজস্ব ভাষা, জাতিসত্ত্বা, সংস্কৃতি নিয়ে ক্রমশ সরব হচ্ছে। হিন্দুদের বিশ্বাসমতে, তাদের দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। আবার আদিবাসী সমাজ মনে করে, দুর্গা আসলে তাদের ‘সম্রাট মহিষাসুর’-এর নাম, যেখানে তিনি পরিচিত ‘হুদুড় দুর্গা’ বলে। হুদুড় শব্দটার অর্থ হল ঝঞ্ঝা, বিদ্যুৎ বা বজ্রের ধ্বনি।
আদিবাসীদের মতে, মহিষাসুরের প্রভাব আর শক্তি ছিল বজ্রের মতোই। আর দুর্গা শব্দটা দুর্গের রক্ষক অর্থে ব্যবহৃত। এক্ষেত্রে দুর্গা পুংলিঙ্গ। হুদুর দুর্গার শাসনকালে নারী, বৃদ্ধ, শিশু, অসহায়দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা নিষিদ্ধ ছিল। আর তাই বহিরাগত আর্যরা এক নারীকে দিয়ে কৌশলে তাঁকে হত্যা করে। নবমীর কালে তাঁর মৃত্যু হয়। দশমীর দিন আর্যরা তাই বিজয় উত্সব পালন করে। আর তাই দিনটিকে ‘বিজয় দশমী’ বলা হয়। এমনটাই বিশ্বাস অসুর জনগোষ্ঠীর।
পুরাণ মতে, মহিষাসুরমর্দিনীর যে যুদ্ধের কাহিনী রয়েছে, আদিবাসী লোকগাথাতেও সেই কাহিনীই রয়েছে। কিন্তু দু’টি কাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। পুরাণে অসুরকে খলনায়ক হিসাবে দেখানো হয়। কিন্তু ঝাড়গ্রামে অসুর জনগোষ্ঠীর মতে, রাজা মহিষাসুরের সময়ে নারীদের অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হত। এবং একজন রাজা কোনও নারীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না, বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না, এরকমটাই ধারণা ছিল আর্যদের। তাই তারা দুর্গাকে দিয়ে অসুর বধ করেছিল। চিরাচরিত ভাবে দুর্গাপুজোর সময়টাতেই মহিষাসুরের জন্য শোক পালন করে থাকে আদিবাসী সমাজ। কোথাও অরন্ধন পালন করা হয়, কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন আদিবাসীরা, যাতে দুর্গাপুজোর যে উৎসব, সেই মন্ত্র বা ঢাকের শব্দ তাদের কানে না যায়। শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, উত্তরবঙ্গেরও বেশ কিছু এলাকাতেও এই জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাঁরাও একইরকম নিয়ম পালন করে আসছেন।
দু’বছর আগেও দুর্গাপুজোর পঞ্চমী থেকেই নিজেদের গৃহবন্দি করে রাখতেন অসুর জনগোষ্ঠীর মানুষরা। তবে এখন সময় বদলেছে। প্রবীণরা আজও দুর্গাপুজোর সময় বাড়ির বাইরে বের হন না। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সব দিক থেকেই আধুনিক হচ্ছে। তাই নিজেদের দেবতাতুল্য মহিষাসুরকে অবজ্ঞা না-করেও দেবী দুর্গার মণ্ডপে গিয়ে অঞ্জলি দিচ্ছে অসুর সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা। প্রতিমা দেখতে বের হয়। মেলাতেও যায়। সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ। যে যার ধর্মীয় সংস্কৃতি পালন করতেই পারে। জাতীয় সম্প্রতি রক্ষার স্বার্থে সব কিছুকে সমান দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা উচিত।