সুস্মিতা ঘোষ: তখন সালটা ১৯৭০। মহানায়ক উত্তম কুমারের রাজত্ব চলছে তখন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে। পিছিয়ে নেই বাংলার তরুণ প্রজন্মও। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে আবির্ভাব হয়, একেকজন দাপুটে অভিনেতা। জন্ম নেয় বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিত্যনতুন তারকা। সাদা-কালো যুগ থেকে আসে রঙিন পর্দার যুগ। আবিষ্কার হয়, বাংলা ইন্ডাস্ট্রির আগামী প্রজন্মের অন্যতম নক্ষত্ররা। হ্যাঁ, যাঁদের মধ্যে একটি অনন্য নাম বর্ষীয়ান অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের। যার দাপট এখনও বহাল। প্রায় ৮০ বছর হতে যায় এই অভিনেতার, কিন্তু এখনও তাঁর নামটা শুনলে মনে পড়ে যায় আশি-নব্বই দশকের তাঁর অভিনীত দাপুটে সিনেমাগুলি। নায়কের চরিত্রে খুব কম অভিনয় করলেও, পার্শ্বচরিত্রে তাঁর জমজমাটি অভিনয় তখনকার ছবিগুলির প্রাণভ্রমরা ছিল। ১৯৭১ সালে ‘মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ’ ছবি থেকে যাত্রা শুরু হয় বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম প্রাণপুরুষ রঞ্জিত মল্লিকের। উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একাধিক কিংবদন্তির সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন তিনি। তাঁর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার জোরে আজও তরুণ প্রজন্মের অভিনেতারা চিটপটাং। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম প্রভাবশালী অভিনেতা হলেন রঞ্জিত মল্লিক। গুরুদক্ষিণা থেকে শুরু করে নবাব, মুখ্যমন্ত্রী, ছোট বউ, মেজো বউ, বড় বউ সহ প্রায় শ-খানেকের বেশি সুপারহিট ছবি তাঁর ঝুলিতে।
১৯৮০-র মাঝভাগ থেকেই তিনি ক্রমশ বড় ভাই, মামা বা সমাজের আদর্শ পুরুষ ইত্যাদি চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। যা কিনা সরাসরি নায়কও নয় আবার নায়কের থেকে কমও নয়। এরকম একজন অভিনেতার দর্শন পাওয়াও খুব ভাগ্যের ব্যপার। সম্প্রতি, আমাদের ‘এই মুহূর্তে’ পরিবার থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল কিংবদন্তির সঙ্গে। সৌজন্যে তাঁর বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস। কলকাতার মল্লিক বাড়ি হল, রঞ্জিত মল্লিকের ভিটে। কলকাতার বুকে এই বনেদি বাড়ির নাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে। অভিনেতার বাড়ির দুর্গাপুজো কলকাতার বিখ্যাত বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো গুলির মধ্যে একটি। তাই তাঁর বাড়ির পুজোর ইতিহাস জানতে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম অভিনেতার সঙ্গে। জানালেন তাঁদের বাড়ির ইতিহাস….
কেমন আছেন দাদা
ভালো আছি
কলকাতার বুকে অন্যতম বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো হিসেবে মল্লিক বাড়ির নামটা প্রথমেই যায়, এই মুহূর্তে পুজোর প্রস্তুতি নিশ্চয়ই তুঙ্গে
হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে প্রায় দীর্ঘদিন ধরে দুর্গোপুজো হচ্ছে। কলকাতার বাড়িতেই প্রায় ১০০ বছর হতে চলল। এই মুহূর্তে প্রস্তুতি মোটামুটি শেষ পর্যায়ে।
বাড়ির পুজো নিয়ে কিছু কথা
পুজোর দিনগুলি আমাদের বাড়িতে খুবই মজা হয়। ছোটবেলা থেকেই আনন্দ করে আসছি এই দিনগুলি। ঠাকুর বানানো দেখতাম, নতুন নতুন জামা কাপড় পরতাম। সব মিলিয়ে দারুণ কাটে এই দিনগুলি। বিশেষ করে, পুজোর সময়ে আমাদের পরিবারের যারা বিদেশ থাকেন, সবাই চলে আসেন। বহুদিন পরে সবার সঙ্গে দেখা হয়, আনন্দে-হুল্লোড়ে মেতে উঠি আমরা সবাই। পুজোর দিনগুলিতে মনে হয় আমরা বোধহয় স্বর্গে বাস করছি।
এখন তো আবার বাড়তি পাওনা (অভিনেতার কন্যা অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের ছেলে) তাঁকে নিয়ে কতটা মেতে থাকেন
হ্যাঁ, তাঁকে নিয়েই মেতে থাকি। গত বছর তাঁকে দিয়ে ঘন্টা বাজানোর চেষ্টা করেছিলাম।
২ বছর করোনা মরসুমে পুজো কেমন কেটেছিল
দু বছর খুবই খারাপ কেটেছে। এমনি সময়ে বাইরের লোকজন ঢুকতে দেওয়া হলেও এই দু বছর পুজোর সময়ে একেবারেই ঢুকতে দোয়া হয়নি মল্লিক বাড়িতে।
পুজোর সময়ে বাইরের মানুষদের প্রবেশাধিকার মেলে
হ্যাঁ, ঠাকুর দেখতে এলে আমরা কাউকে না করিনা। তবে একেক সময়ে এতটাই ভিড় জমে যায় যে, আমরা আঁতকে উঠি। কেনো এ এত ভিড় তখন কন্ট্রোল করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাই খুবই ভয় পেয়ে যাই তখন, নতুবা সবাই ঢুকতে পারে তখন আমাদের বাড়িতে।
স্বাভাবিক ব্যপার কলকাতার বুকে এত বড় অভিনেতার বাড়ির এটি বছরের পুজো তা দেখতে তো উত্তেজনা থাকবেই সবার
হ্যাঁ, সে তো বটেই! উত্তেজনা যে কী পরিমাণে থাকে তা বলাই বাহুল্য। কোথা থেকে কোথা থেকে যে লোকজন আসে। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, বাংলাদেশ থেকেও লোকজন আসে আমাদের বাড়িতে পুজো দেখতে। এছাড়া দেশের নানা প্রান্ত থেকে এই সময়ে লোকজন আসেন। মাঝে মাঝে এত ভিড় আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে, তবে খুবই মজা পাই।
কোয়েল দি এখানেই থাকেন পুজোর এই চারটে দিন?
না না কোয়েল আসা যাওয়া করে। সকালে এলো, দুপুরে চলে গেলো আবার রাতে এলো।
এই দিনগুলিতে ট্রেডিশন অনুযায়ী আপনাদের বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই ধুতি-পাঞ্জাবী কিংবা শাড়ীতে সাজেন
হ্যাঁ, ধুতি-পাঞ্জাবীর থেকে পাঞ্জাবী-কুর্তাতেই সবাই সাজে, আর মেয়েরা শাড়ী।
পুজোর খাওয়া-দাওয়া
পুজোর দিনগুলির মধ্যে সপ্তম-অষ্টমী-নবমী একেবারেই কড়া নিরামিষ। কোনই পেঁয়াজ-রসুন মাছ মাংসের ছোঁয়া থাকবেই না এই তিনদিন। আর দশমীর দিন আমাদের বাড়িতে মাংস রান্না হবেই। আরেকটি বিশেষ পদ হয়, তা হলো মেটের চচ্চরি, যা খেতে একেবারে যুদ্ধ লেগে যায় আমাদের বাড়ির সবার মধ্যে। এতটাই সুন্দর হয়।
পুজোর দিনগুলিতে ছোটবেলার কোনো স্মৃতি
খুব খুব মজা। নতুন নতুন জামা কখন কিনব সেই নিয়ে আলাদাই একটি উন্মাদনা থাকতো। বিশেষ করে নতুন জুতো কিনলে তা দু তিনদিন আগে থেকেই পরা শুরু করে দিতাম। যাতে পুজোর দিনে জুতো কোনো অসুবিধা না করে, যাতে ফোঁসকা না পড়ে যায়। এছাড়া বাড়িতে নাচ গান, হই হুল্লোড় এলাহি ব্যাপার। আরেকবার না বলে থাকতে পারছিনা যে, পুজোর এই কটা দিন আমরা স্বর্গে বাস করি। আর সবথেকে আনন্দকর বিষয় হল, প্রত্যেকের মুখে হাসি দেখে তখনই আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। নিজে তো খুশিতে থাকিই, কিন্তু অন্যরা যখন আনন্দ পাচ্ছে দেখি, তখন আমি বেশি আনন্দ পাই।
আন্তর্জাতিক হেরিটেজ আখ্যা পেল কলকাতার দুর্গাপুজো, আপনি কলকাতা বাসি হয়ে কতটা গর্বিত
খুবই আনন্দিত। যদি এই তকমা না ও পেতো। তাতেও কিছু হত না। আমাদের কলকাতা দুর্গাপুজো কোনো কিছুতেই আটকাবে না। এই পুজো টপ লেভেলে থাকবে অনন্ত কাল। এছাড়াও দুর্গাপুজোর সঙ্গে কত কিছু জড়িয়ে রয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিকটা। এই পুজোর সঙ্গে জড়িত যারা, যেমন, কুমোরটুলি, যারা প্যান্ডেল গড়ছেন, যারা ফলমূল বিক্রি করেন, যারা ইলেকট্রিক দিকটা দেখেন, যারা কাপড় জামা বিক্রি করছেন, যারা সাজের কাজ করছেন সবদিক থেকে ব্যবসা-বানিজ্য এই সময় ফুলে ফেঁপে ওঠে। একটা পুজোকে কেন্দ্র কতগুলো ব্যবসার উন্নতি হচ্ছে। এটাও তো বড় ব্যাপার তাইনা, ভালো রোজগার হচ্ছে সুতরাং এই সবার মুখে হাসি থাকছে। এটাই আনন্দের।
থিম ও সাবেকি কোনটা পছন্দের
অবশ্যই সাবেকি। পুজোটা সাবেকি ভালো। এছাড়া থিমের পুজো সুন্দর, সেটাও আমার ভালো লাগে। নানারকম সাজের প্যাণ্ডেল হচ্ছে। কিন্তু ঠাকুরকে অন্যরকম কিছু করা আমার পছন্দ নয়।
বাড়ির পুজোতে কতটা অংশগ্রহণ করেন
১০০%। বাড়ির রান্না-বান্না। সবার সঙ্গে থাকা, বাড়ির নাচ গান এই দিনগুলি বাড়ি ছেড়ে তেমন বেরোনো হয় না। পুজোর পরিক্রমাতেও যাওয়া হয় না। মোট কথা বাড়ির আনন্দ ছেড়ে একদমই বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করেনা। ওই আসা যাওয়ার পথে কিছু ঠাকুর দর্শন করি।
পুজো সামনে। আমাদের ‘এই মুহূর্তে’ নিউজ পোর্টালের পেইজে আমরা প্রতিনিয়ত আপনাদের পুজো সম্পর্কিত নানা আপডেট দিচ্ছি। তাই প্রতি মুহূর্ত আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন এটাই আমাদের কাম্য।