নিজস্ব প্রতিনিধি: রাজতন্ত্র আজ আর নেই। তবুও রাজকীয়ভাবেই পুজো হয় পুরুলিয়ার কাশিপুর রাজ পরিবারের কুলদেবী রাজরাজেশ্বরী শিখরবাসিনী দুর্গার। এই পুজো হয় বীরাচারী তন্ত্রমতে। পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবার, জানা যায়, প্রায় ২০০০ বছরের প্রাচীন অষ্টধাতুর মূর্তিতেই পুজো পান মা দুর্গা। তবে এই পুজোর একটি বৈশিষ্ট অন্যান্য পুজোর থেকে আলাদা। কারণ, এখানে মা দুর্গা পূজা পান, গুপ্তাতিগুপ্ত ‘শ্রীনাদ’ মন্ত্রোচ্চারনের মাধ্যমে। প্রায় ২০০০ বছরের প্রাচীন এই মন্ত্র আজও লিপিবদ্ধ হয়নি। তাই এই মন্ত্র আজও অপ্রকাশিত। শুধুমাত্র বংশ পরম্পরায় পুরোহিতরা জানছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। আর একটি রীতিও বেশ আশ্চর্য এই পুজোর। মহালয়ার ৬ দিন আগেই বোধন হয় পঞ্চকোট রাজবাড়িতে।
শিখরবাসিনী দুর্গা মূর্তিটি অষ্টধাতুর। দেবী এখানে চতুর্ভুজা এবং কমলাসনা। দেবীর বেশ রাজরাজেশ্বরী। দেবী এখানে ষোলদিন ধরে পুজো পান। আর্দ্রা নক্ষত্র যুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে হয় মায়ের বোধন। পুজো হয় মহানবমী পর্যন্ত। ফলে এই কাশিপুর রাজ পরিবারের পুজোকে ষোলকল্পের পুজোও বলা হয়। মহাসপ্তমীর দিন অর্ধরাত্রি বিহীত পুজো শেষ করার পর দেবীর আসন পরিবর্তন হয়। দশমীর পূর্বাহ্ন পর্যন্ত মাকে এক গুপ্ত আসনে বসানো হয়। ওই গুপ্ত আসনকে বলা হয় ষোড়ন। এই সময় একটি তলোয়ারও পুজো পায়। যার নাম ‘ভূতনাথ তাগা’। বছরের বাকি সময় শিখরবাসিনী দুর্গা পুজো পানঐতিহ্যশালী বেদিতে। মার্বেল পাথরের একটি রুপোর সিংহাসনের মাঝে সোনার সিংহাসনের মাথায় দেবীর অধিষ্ঠান।
কেন একে শিখরবাসিনী দুর্গা বলা হয়? নানান পৌরানিক ব্যাখ্যা ও জনশ্রুতি আছে। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেও-র কনিষ্ঠ পুত্র দামোদর শেখর সিং দেও বাহাদুর অধুনা জঙ্গলমহলের চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই এই পুজোর প্রবর্তন করেন শ্রী রামচন্দ্র দুর্গাদেবীর ‘অকালবোধন’ আরাধনার প্রথা মেনে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রাচীন ধার নগরের প্রথা এবং কুলাচার। জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ন এলাকায় রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন দামোদর শেখর সিং দেও।
তাঁরই নামানুসারে এই এলাকার নাম হয়েছিল ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’। যা থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুর্গার নাম শিখরবাসিনী দুর্গা। রাজবংশের রাজধানী গড়পঞ্চকোট থেকে এই পুজোর শুরু। পরবর্তী সময় রাজধানী স্থানান্তরিত হয় পাড়া, কেশরগড় হয়ে বর্তমান কাশীপুরে। কিন্তু পুজো আজও একই নিয়ম-নীতি ও আচার মেনে হয়ে চলেছে গুপ্ত মন্ত্রে। বনমালী পণ্ডিতের হাত ধরে এই পুজো হয়। তাঁরই দেওয়া গুপ্ত মন্ত্রে তাঁর বংশধররা আজও পুজো করছেন এই মন্দিরে। রাজপরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস, তাঁদের রাজরাজেশ্বরী দেবী-ই হলেন আসানসোলের কল্যানেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। তিনিই মহাষ্টমীর দিন আসেন বিশেষ পুজো নিতে। যার প্রমানস্বরূপ দুর্গা যন্ত্রে সিঁদুরের উপর পায়ের ছাপ থাকে প্রতিবছর।