এই মুহূর্তে




পতিত হয়েছিল দেবী সতীর মুকুটের মণি, জানুন ঢাকেশ্বরীর অজানা কাহিনি




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত এই ঢাকেশ্বরী মন্দির (Dhakeshwari Temple) হিন্দু শাক্ত তীর্থস্থানগুলির অন্যতম। এই মন্দিরটি শুধু বাংলাদেশের বৃহত্তম হিন্দু মন্দিরই নয়, বরং হিন্দু ধর্মের ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম হিসেবেও স্বীকৃত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নামের পিছনে রয়েছে একাধিক কিংবদন্তি। তবে ঢাকেশ্বরী নাম থেকে অতি সহজেই এর আক্ষরিক অর্থ বুঝতে পারা যায়। ঢাকেশ্বরী অর্থে “ঢাকার ঈশ্বরী” অর্থাৎ ঢাকার রক্ষাকর্ত্রী দেবী। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, এই দেবী থেকেই ‘ঢাকা’ নামটির উৎপত্তি। “ঢাকা” অর্থ “আবৃত” বা “ঢাকা অবস্থায় থাকা” এবং “ঈশ্বরী” মানে দেবী — সেই অর্থে দেবী এখানে জঙ্গলে ঢাকা অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছিলেন বলে তাঁর নামকরণ হয় ঢাকেশ্বরী। এই মন্দিরকে  ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরও বলা হয়। এটি শুধু একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, বরং বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতীক। এই মন্দিরকে বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির হিসেবে গণ্য করা হয়।

শক্তিপীঠ হিসেবে গুরুত্ব

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী সতীর আত্মাহুতির পর দেবাদিদেব সতীকে কাঁধে নিয়ে ঘোরাকালীন শ্রী বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে যখন ভগবতী সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে কাটছিলেন, তখন তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং সেই স্থানগুলোতে গড়ে ওঠে শক্তিপীঠ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সতীর কিরিট বা মুকুটের মণি পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এ কারণে এটিকে একটি উপ-পীঠ (উপ-শক্তিপীঠ) হিসেবে গণ্য করা হয়। শক্তিপীঠ হিসেবে এই স্থানটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিকট অতীব পবিত্র এবং পূজাযোগ্য স্থান হিসেবে বিবেচিত। স্বনামধন্য সাহিত্যিক যতীন্দ্রমোহন রায় তার ঢাকা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের ভবিষ্য ব্রহ্মখণ্ডে  বলেছেন:

বৃদ্ধ গঙ্গাতটে বেদ বর্ষ সাহস্র ব্যত্যয়ে

স্থাপিতব্যঞ্চ যবনৈ জাঙ্গিরং পতনং মহৎ।

তত্র দেবী মহাকালী ঢক্কা বাদ্যপ্রিয়া সদাঃ

গাস্যন্তি পত্তনং ঢক্কা সজ্ঞকং দেশবাসিনঃ। 

ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা

মন্দিরটি দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে অনেক গবেষক মনে করেন। জনশ্রুতি রয়েছ, বল্লাল সেন শৈশবে একটি জঙ্গলে দেবীমূর্তি আবিষ্কার করেন এবং মনে করেন যে এই দেবীই তাঁকে সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছেন। পরবর্তীতে রাজ সিংহাসনে বসার পর তিনি সেই স্থানেই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। দেবীমূর্তিটি গাছপালায় ঢাকা অবস্থায় পাওয়া যাওয়ায় মন্দিরের নামকরণ হয় ‘ঢাকেশ্বরী’—অর্থাৎ ঢাকার ঈশ্বরী বা রক্ষাকর্ত্রী। এই নাম থেকেই ‘ঢাকা’ শহরের নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে।

স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী

যদিও মন্দিরটি বহু প্রাচীন, তবে এর বর্তমান কাঠামো অনেকাংশেই আধুনিক। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন বাংলার মন্দির নির্মাণে চুন-বালির ব্যবহার প্রচলিত ছিল না, কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দির নির্মাণে চুন-বালি ব্যবহৃত হয়েছে, যা মুসলিম আমলের স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব নির্দেশ করে। বহুবার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের ফলে মূল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য অনেকটাই বিলুপ্ত হয়েছে।

১৭শ শতকে বাংলার সুবেদার মানসিংহ মন্দিরটি সংস্কার করেন এবং চারটি শিবলিঙ্গসহ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। তবে তার সংস্কারের নির্দিষ্ট প্রমাণ ইতিহাসে খুব একটা নেই। ইংরেজ লেখক এফ বি ব্রাডলি বার্ট ১৯০৬ সালে উল্লেখ করেন, বর্তমান মন্দিরটি প্রায় ২০০ বছর পুরোনো এবং এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক হিন্দু এজেন্ট নির্মাণ করেন।

দেশভাগ ও মূল বিগ্রহের স্থানান্তর

জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আশঙ্কায় দেবী ঢাকেশ্বরীর আনুমানিক ৮০০ বছরের পুরোনো মূল বিগ্রহটি ১৯৪৮ সালে গোপনে ঢাকার মন্দির থেকে কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। কলকাতার কুমারটুলি এলাকার দুর্গাচরণ স্ট্রিটে শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে এই বিগ্রহটি আজও পূজিত হয়। এই বিগ্রহটি দেড় ফুট উচ্চতার, দশহাতবিশিষ্ট কাত্যায়নী দুর্গা, যিনি মহিষাসুরমর্দিনী রূপে অবস্থান করছেন। দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ এবং বাহন হিসেবে সিংহের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

বর্তমান বিগ্রহ ও পূজা

ঢাকায় বর্তমান ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যেটি পূজিত হয়, সেটি মূল বিগ্রহের প্রতিরূপ। এখানে নিয়মিত পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং দুর্গাপূজা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ও আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপন করা হয়। এটি ঢাকার অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থী এখানে সমবেত হন।

অবস্থান ও স্থাপনা বিবরণ

মন্দিরটি ঢাকার পুরান ঢাকার পলাশী ব্যারাক এলাকায় অবস্থিত, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রাবাসগুলোর পাশে ঢাকেশ্বরী রোডের উত্তরে একটি প্রাচীরঘেরা কম্পাউন্ডে। মন্দির কমপ্লেক্সটি দুটি ভাগে বিভক্ত—অন্তর্বাটি ও বহির্বাটি। অন্তর্বাটিতে রয়েছে মূল মন্দির, নাটমন্দির এবং অন্যান্য পূজারিক স্থান। বহির্বাটিতে রয়েছে পান্থশালা, কয়েকটি মন্দির এবং নানা প্রাসঙ্গিক ভবন। এছাড়া, একটি প্রাচীন দিঘি ও একটি বিশাল বটগাছ রয়েছে, যা মন্দিরটির নান্দনিক পরিবেশকে আরও পবিত্র ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে।

মূল মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে মহানগর পূজামণ্ডপ অবস্থিত, যেখানে বড় পরিসরে পূজানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় একটি লাইব্রেরিও রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় বই, ইতিহাস ও গবেষণাপত্র সংরক্ষিত থাকে।

পর্যটন ও জনপ্রিয়তা

ঢাকেশ্বরী মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং পর্যটকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক ও গবেষক এই মন্দির পরিদর্শন করেন এর ইতিহাস ও স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য অন্বেষণের উদ্দেশ্যে। ঢাকেশ্বরী মন্দির কেবলমাত্র একটি উপাসনাস্থল নয়, এটি বাংলাদেশের হিন্দু ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক মহামূল্যবান অংশ। এটি আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বাসেরও এক মূর্ত প্রতীক। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির, হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান এবং শক্তিপীঠ। যারা বাংলাদেশে ভ্রমণ করেন, তাদের জন্য ঢাকেশ্বরী মন্দির একটি অপরিহার্য গন্তব্য। এই মন্দিরের শক্তিপীঠ হিসেবে অবস্থান, প্রাচীনতা, কিংবদন্তি, দেশভাগের ইতিহাস এবং বর্তমান ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব—সব মিলিয়ে এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। তাই নিঃসন্দেহেই ঢাকেশ্বরী মন্দির কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির আলোকে বিবেচিত হওয়া উচিত।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার শেখ হাসিনার নাতি

‘তোমায়…..দিবা’, এনসিপি নেত্রীকে অশালীন প্রস্তাব ইউনূস ঘনিষ্ঠের, তোলপাড় বাংলাদেশ

একদিনেই ৫ ড্রিমলাইনার বিমান উড়ান বাতিল এয়ার ইন্ডিয়ার, আতঙ্কিত যাত্রীরা

খামেনির দশা হবে সাদ্দাম হুসেনের থেকেও খারাপ, হুঙ্কার ইজরায়েলের

মুক্তিযুদ্ধে একাই খতম করেছিলেন ৬ রাজাকারকে, না ফেরার দেশে বীরাঙ্গনা সখিনা

বাড়িতে পৌঁছল ভেঙে পড়া বিমানের পাইলটের দেহ, কান্নায় ভেঙে পড়লেন বাবা

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ