নিজস্ব প্রতিনিধি: জলপাইগুড়িতে এক রিহ্যাব সেন্টারে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ময়ূখ গুহের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে এখন রীতিমত শোরগোল পড়ে গিয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই এই রিহ্যাব সেন্টারের একের পর এক অবৈধ কার্যকলাপ যেমন সামনে আসছে তেমনি এখানকার আবাসিকদের সঙ্গে রিহ্যাবের কর্মীরা কী নৃশংস অত্যাচার চালাতো সেই ঘটনাও সামনে আসছে। এমনকি ওই রিহ্যাব সেন্টারে আবাসিকদের ওপরে যে যৌন নির্যাতনও করা হত সেটাও এবার সামনে এসেছে। কেননা ময়ূখের বাবা-মা এখন অভিযোগ তুলেছেন ওই রিহ্যাব সেন্টারে ময়ূখকে বেধড়ক মারধর করার পাশাপাশি তাকে যৌন নির্যাতনও করা হয়েছে। আর এই ঘটনা সামনে আসতেই গোটা বিষয়টি ভিন্ন পথে মোড় নিয়েছে।
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি থানার শদীহগড় এলাকার বাসিন্দা বিভাস গুহ ও রুমকি গুহের ছেলে ময়ূখ গুহ জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র ছিল। আগামী বছরই তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা। কিন্তু গত দুই বছর ধরে মোবাইল গেমে তীব্র আসক্ত হয়ে পড়েছিল ময়ূখ। তার জেরে বিঘ্নিত হচ্ছিল তার পড়াশোনাও। কোভিড কালে সেই আসক্তি আরও বেড়ে যাওয়ায় গুহ দম্পতি সিদ্ধান্ত নেন ময়ূখকে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠানোর। সেই মতো তাঁরা গত জুলাই মাসে জলপাইগুড়ি পান্ডাপাড়া এলাকার পরিবর্তন ফাউন্ডেশন নামের রিহ্যাব সেন্টারে ময়ূখকে ভর্তি করান। সেখানেই গত ৩ মাস ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিল ময়ূখ। গতকাল সকালে সেখান থেকে গুহ দম্পতির কাছে ফোন আসে যে ময়ূখ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই খবর পেয়েই তড়িঘড়ি গুহ দম্পতি সেখানে পৌঁছে দেখেন তাঁদের একমাত্র ছেলে মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অথচ আশেপাশে রিহ্যাব সেন্টারের কোনও কর্মীই সেখানে নেই। তারপরেই তাঁরা ময়ূখের মৃত্যুর জন্য ওই রিহ্যাব সেন্টারের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তোলেন। একই সঙ্গে পুলিশেরও দ্বারস্থ হন।
গুহ দম্পতির অভিযোগ ও ময়ূখের মৃত্যুর জেরে বৃহস্পতিবার রাতেই ওই রিহ্যাব সেন্টারে হানা দেয় পুলিশ। সেখানে তাঁরা সিসি টিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি তা সংগ্রহ করেন ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক বাজেয়াপ্ত করেন। একই সঙ্গে ওই রিহ্যাব সেন্টার সিল করে দেন। ময়ূখের মৃত্যুর পরে পরেই ওই রিহ্যাব সেন্টারের ম্যানেজার গা ঢাকা দিয়েছে। তবে পুলিশ হোমের কর্ণধার সৈকত মণ্ডল এবং তার বাবা সুকান্ত মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে। সেই সঙ্গে সেখানকার আবাসিকদের জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। পাশাপাশি যোগাযোগ করা হয় তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও। তদন্ত যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই এই রিহ্যাব সেন্টারের সম্পর্কে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য সামনে আসছে।
জানা গিয়েছে, বিগত ৫ বছর ধরে বৈধ কোনও নথি ছাড়াই রমরমিয়ে চলছিল এই রিহ্যাব সেন্টারটি। নিয়ম অনুযায়ী এইও সেন্টারে স্থায়ী কোনও চিকিৎসক ছিল না। বাইরের চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা করানো হত। ঠিক মতো খেতে দেওয়া হতো না আবাসিকদের। দেখা করতে দেওয়া হতো না পরিবারের কারোর সঙ্গে। অথচ আবাসিকদের পরিবারের কাছ থেকে প্রতিমাসে মোটা টাকা নেওয়া হতো। শুধু তাই নয়, দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে পা ওপরে আর মাথা নিচে করে ঝুলিয়ে দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হতো আবাসিকদের। আর এখন তো আরও বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছেন খোদ ময়ূখের বাবা-মা। তাঁদের অভিযোগ, রিহ্যাব সেন্টারে আবাসিকদের নিয়মিত যৌন নির্যাতনও করা হত, যার শিকার হয়েছিল ময়ূখও। কেননা তার গোপোনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। পাশাপাশি পায়ের পাতাতেও আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। তাই সঠিক তদন্তের জন্য দেহের ময়নাতদন্তের সময় ভিডিওগ্রাফির দাবি জানিয়েছে পরিবার। ইতিমধ্যেই ময়ূখের দেহ ময়নাতদন্তের জন্য উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে। সব ঘটনা দেখে এখন ওই হোমের আশেপাশের বাসিন্দারা দাবি তুলেছেন হোমটি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হোক।