নিজস্ব প্রতিনিধি: ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোর মঞ্জির…’ এক সময় মহালয়ার সকাল মানে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চন্ডীপাঠ দিয়ে মহালয়ার (MAHALAYA) সকাল শুরু হত। বর্তমানে আধুনিক ডিজিট্যাল যুগে বিকল্প অনেক কিছু। একাধিক মোবাইল অ্যাপ, রেডিও অ্যাপ, ইউটিউব থাকার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে পুরানো সেই রেডিও।
ধুলো পড়ে থাকা রেডিওটি ঝাড়তে ঝাড়তে মহালয়া নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুরের প্রবীণ সাংবাদিক দিলীপ কুমার তালুকদার। তাঁর হাতে লেখা অনেক প্রতিবেদন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে একসময়। মহালয়ার প্রাক্কালে তিনি বললেন, টেকনোলজির ভিড়ে যে রেডিয়ো সেটটির কথা মনে থাকে না আপামর বাঙালির, সেই রেডিওই সময় সরণী বেয়ে মহালয়ার আগে ফিরে আসে হারানো স্মৃতি নিয়ে৷ যে স্মৃতিতেই লুকিয়ে আছে আপন সত্ত্বা৷ ঘুম চোখে ভোর চারটেয় বালিশের পাশে রাখা রেডিয়ো অন করলেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে…’ ৷ হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ বাঙালির চিরন্তন এক আগমনী৷ ইউটিউব, এমপি থ্রি ফাইল, সিডি বা ডিভিডি —যাতেই সেই প্রোগ্রামের রেকর্ডিং থাকুক না কেন, মহালয়ার ভোরে আকাশবাণীর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান শোনার মধ্যে হয়ত লুকিয়ে বাঙালির স্মৃতি-সত্তা৷ না হলে কেন, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত বালুরঘাট গঙ্গারামপুর, বুনিয়াদপুর সহ প্রত্যন্তগ্রাম, সর্বত্রই মহালয়ার ঠিক আগে আগে রেডিয়ো সেট সারানোর এত ব্যাকুলতা?
সাবেক রেডিয়োর জায়গায় এসেছে ডিজিটাল এফএম৷ তবে আজও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মার্কেটে, একাধিক দোকানে রেডিয়োরও খোঁজ করছেন অনেকে৷ যা বলছে বাঙালির নস্টালজিয়ার প্রতি টান বদলায়নি আজও৷ বছর পঁচাত্তরের গোপাল ভট্টাচার্য কিংবা বছর তিরিশের নিতাই পাল দুজনেই ধুলো ঝেড়ে দু’টি ভাঙাচোরা রেডিও নিয়ে হাজির হয়েছেন একটি ইলেকট্রনিক্স দোকানে৷ তাঁদের বক্তব্য , ‘যতই রঙিন টিভিতে অনুষ্ঠান হোক, রেডিওতে ওই অনুষ্ঠান না শুনলে মনে হয়, ঠিক ভাবে পুজো শুরু হল না৷’ জেলার এক দোকান ‘রিন্টু ওয়াচ সার্ভিস ’-এর মালিক পিন্টু মণ্ডল বলেন, ‘আগে রেডিও, টেপ সারাই করেই সংসার চালাতাম৷ এখন ওসবের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘড়ি, টিভি সারাই করি৷ তবে মহালয়ার আগে ফি বছর এই দোকানেই রেডিও প্রেমীরা ভিড় করেন রেডিও সারানোর জন্য৷ ’ আরও একজন রেডিও প্রস্তুত ও সারাইকারী দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘গতকালই একজনকে রেডিয়ো সারিয়ে দিলাম৷ নতুন প্রজন্ম অবশ্য মোবাইলেই শোনে সবকিছু৷ আগের মতো না হলেও এখনও মাঝে মধ্যে রেডিয়ো সারাই করার জন্য অনেকে আসেন’।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রত্যন্তগ্রাম রামপাড়া চেঁচড়া। সেখানেই রেডিয়ো বিক্রি ও মেরামতির কাজ করছেন উৎপল চন্দ্র দত্ত, প্রায় ৩০ -৪০ বছর ধরে৷ তাঁর কথায়, ‘এ বছর এখনও পর্যন্ত ১০টা রেডিয়ো বিক্রি করেছি৷ মহালয়ার আগে ৮টি রেডিয়ো সারিয়েছি৷’
ছবিটা একটু অন্যরকম বুনিয়াদপুর হাটখোলায়। রেডিয়ো ব্যবসায়ী বাপ্পা রায় বললেন, ‘রেডিয়ো সারাতে আগে যত মানুষ আসতেন, এখন তার বিশ শতাংশও আসেন না৷ তবে মহালয়ার আগে রেডিয়ো সারানোর কাজ বাড়ে৷ গত বছর এ সময় পাঁচটি রেডিয়ো সারিয়েছি৷ এ বছর এখনও পর্যন্ত তিনটে৷’ আরও এক বিক্রেতা শিবনাথ ঘোষের বক্তব্য, ‘এখন চিনা রেডিয়োও বেশি বিকোচ্ছে৷ অনেকেই এফএম রেডিও কেনেন মহালয়ার আগে৷ এই সময় আগে ৩০০ -৪০০ নতুন রেডিয়ো বিক্রি হতো৷ এখন ডিজিট্যাল রেডিয়ো কেনা ও সারাইয়ের কাজটা বেশি৷ মোবাইলেও তো এখনএফএম থাকে৷’ তবু অনেকেই স্রেফ নস্টালজিয়ার টানেই রেডিয়ো আঁকড়ে৷ ওঁদের কাছে দশপ্রহরণধারিণী আবির্ভূতা হবেন আকাশবাণীতেই (AKASHVANI)৷