নিজস্ব প্রতিনিধি: পৃথিবীর প্রাচিনতম জনপদগুলির অন্য়তম কাশী। কথিত আছে দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের উপর অবস্থান কাশীর। এখানে দ্বাদশ জ্য়োতির্লিঙ্গের অন্য়তম বিশ্বনাথ মন্দির ছাড়াও অন্নপূর্ণা মন্দির দেখতে সারা পৃথিবী থেকেই লক্ষ লক্ষ পূর্ণার্থী আসেন কাশীধামে। কিন্তু আজ আমরা আলোচনা করব কাশী বা বারানসীর বাঙালিটোলার দুর্গাপুজো নিয়ে।
কাশী বা বারানসী শহরে প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি বাঙালি বসবাস করেন। তাই এখানে শিবের ঘরনি দুর্গা একটু বেশিই আদরযত্ন পাবেন সেটা বলাই বাহুল্য। তাই বেনারসে দুর্গাপুজোর চল একটু বেশি উত্তরপ্রদেশের অন্য়ান্য় শহরের থেকে। পুজোর সময় বেনারস বা বর্তমানে বারানসী স্টেশন থেকে গোধুলিয়া মোড়ের দিকে যত এগোবেন ততই আপনার বাঙালি স্বত্ত্বা জেগে উঠবে। কারণ, থেকে থেকেই ঢাকের বাদ্য়ি কানে আসবে। আর নাকে আসবে ধূপ, ধুনো, কর্পূর, ঘি, সমিধ মিশ্রিত সেই অপার্থিব গন্ধ।
কথিত আছে, ১৭৭৩ সালে বেনারসে বাঙালি রীতিতে দুর্গাপুজো শুরু করেন জমিদার আনন্দময় মিত্র। আবার ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের রানি ভবানী দুর্গা কুণ্ড মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরের সঙ্গে যে কুণ্ড রয়েছে তা সরাসরি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত। বারানসীর প্রাচীন দুর্গাপুজোর মধ্য়ে অন্য়তম পাঁড়ে ধর্মশালার পুজো। এর পাশেই আছে হরসুন্দরী ধর্মশালা। গোধূলিয়া থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে মদনপুরা জঙ্গমবাড়ি। এই পুরাতন দুর্গাবাড়ীতে ১৭৬৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত মা দুর্গার মাটির মূর্তি আজও অমলিন। তাজ্জব ব্যাপার এই যে ২৫৪ বছর পরও মাটির তৈরি মা দুর্গার এই প্রতিমা যেমন ছিল তেমনই আছে। বিশ্বাস করুন না করুন, এটি সত্য়িই একটি অলৌকিক ঘটনা।
পাঁড়ে ধর্মশালা বা হরসুন্দরী ধর্মশালায় পুজোর কটা দিন বাঙালি খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ পাবেন। এই ধর্মশালাগুলিতে ঢুকলেই মনে হবে চলে এসেছেন ১৯ শতকের কোনও এক জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে ঢুকে পড়েছেন। তিনদিক ঘেরা বারান্দা আর তার পিছনে ঘর, সেখানে মায়ের পুজো হচ্ছে। এছাড়া গোধূলিয়া থেকে দেড়-দুই কিমি দূরত্বে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো বা সিগরা-তে ভারত সেবাশ্রমের পুজোও ঘুরে আসুন অবশ্যই। তবে দুপুরে গেলে সেখানে চমৎকার ভোগ খেতে পারবেন।
গোটা বেনারস শহরে কম-বেশি ৩০০-টির মতো দুর্গাপুজো হয়। প্রাচীন এই শহরে একদিকে অবাঙালিরা যেমন নবরাত্রি পালন করেন, তখন বাঙালি সম্প্রদায় দুর্গাপুজো করেন। এখানে আজও থিমের পুজোর রমরমা নেই। পুজোতে যদি বেনারস ঘুরতে যান, তবে একটা জিনিস অবশ্যই চোখে পড়বে। দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে সেন্টিমেন্ট কাজ করে, ঘরের মেয়ে উমা চারদিনের জন্য এসেছে বাপেরবাড়ি, এমনটা আপনি বেনারসেও লক্ষ্য করবেন। আর আরেকটা বিষয়, এই শহরে কলাবউ বা নবপত্রিকাকে কিন্তু লালপাড় সাদা শাড়িতে দেখতে পাবেন না, দেখবেন বিশুদ্ধ বেনারসী শাড়িতে। এটাই এখানকার দুর্গাপুজোর মূল বৈশিষ্ট বলতে পারেন।
পুজোর একদিন চলে আসুন বেনারস থেকে ৬৩ কিমি দূরে বিন্ধ্যাচলে। এখানে আছে অতি প্রাচীন দেবী বিন্ধ্য়বাসিনী মন্দির। গোধূলিয়া থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়, রেট দরদাম করে নিতে হবে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দুর্গা সপ্তশতীতে উল্লেখ আছে মহিষাসুরকে বধ করার সময়ে দেবী অনেকগুলি রূপ ধারণ করেন, তার মধ্যে একটি হল দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। এখানেও দুর্গাপুজো হয় মহা ধুমধাম করে।
একটা সময় বিজয়া দশমীর বিকেলে বেনারসে ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসীদের লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, তরোয়াল নৃত্য দেখা যেত। শোভাযাত্রা করে দেবী প্রতিমা নিয়ে আসা হত ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাটে, তখনই সন্নাসীরা তাঁদের নানান কসরত দেখাতেন। এরপর মা দুর্গাকে বসানো হত সুসজ্জিত বজরায়। পাশেই দশাশ্বমেধ ঘাটে তখন আরেকটি বজরার উপর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিমা উপবিষ্টা। ঠিক সন্ধে ছটার সময় ঘাটে যখন গঙ্গারতি শুরু হত, তার সাথেতাল মিলিয়ে নিজেদের বজরার উপর আশ্রম ও সংঘের সন্ন্যাসীরা করতেন প্রতিমা বিসর্জনের আরতি। আরতি শেষে বজরা এগিয়ে যেত মাঝনদীতে। শেষে প্রতিমা নিরঞ্জন সেখানেই। কালের নিয়মে এই রীতি এখন আর নেই। ২০১৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে গঙ্গাতে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ হয়ে গেছে।
আর একটি কথা না বললেই নয়, বাঙালিটোলার কাছে গোল্ডেন স্পোর্টিং ক্লাবের বেনারসের বারোয়ারি পুজোগুলোর মধ্যে অন্য়তম। এখানকার প্রতিমা সবচেয়ে বড়। আর এর শোভাযাত্রাও এক অন্য় মাত্রা পায় গোটা বেনারসে। এবার আসি কেদারনাথ মন্দিরের কাছে দুর্গাবাড়ি প্রসঙ্গে। শোনা যায় একবার ভাসানের সময় দেবী স্বপ্ন দেন তাঁকে বিসর্জন না দিয়ে সারা বছর শুধুমাত্র ছোলা-গুড় দিয়ে পুজো করলেই হবে। প্রায় আড়াইশো বছর এই প্রথা চলে আসছে। মাটি, খর, বাঁশ দিয়ে তৈরি এখানকার দুর্গাপ্রতিমা ২৫৪ বছরেও ক্ষয় হয়নি। বর্তমান জ্ঞান -বিজ্ঞানের যুগে, বেনারসের এই দুর্গাপ্রতিমা কোনও অলৌকিক ঘটনার থেকে কম নয়।
পুরাতন দুর্গাবাড়ীতে ১৭৬৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত মায়ের মৃন্ময় মূর্তিটি দেখে বিজ্ঞানীরাও হতবাক। ক্ষয় রোধে রাসায়নিক আবরণ বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই, তবুও বিস্ময়কর পাঁচ ফুটের মূর্তিটি আগের মতই রয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলির বাসিন্দা মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর থেকে সেই মূর্তিটি একই বেদীতে একইভাবে রয়েছে যেখানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তৈলাক্ত রঙে গড়া দুর্গা মূর্তির সঙ্গে রয়েছে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকেয় এবং মহিষাসুর। তাই পুজোর কয়েকটা দিন আনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন বারানসী। কখনই মনে হবে না আপনি বাংলার বাইরে রয়েছেন। চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ এবং ঢাকের আওয়াজ।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে বেনারস যাওয়ার সবচেয়ে ভালো ট্রেন বিভূতি এক্সপ্রেস। এছাড়া হাওড়া এবং কলকাতা স্টেশন থএকে বেশ কয়েকটি ট্রেন বেনারস যায়। তবে ট্রেনের সময়াবলী ভালো করে দেখে নেবেন। কারণ বেশিরভাগ ট্রেনই বেনারস পৌঁছায় বেশি রাতে। এছাড়া সরাসরি বেনারসের ট্রেনের টিকিট না পেলে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্য়ায় বা মোগলসরাই স্টেশনে নেমেও অটো বা বাসে পৌঁছে যেতে পারেন বেনারস বা বারানসী, যে নামেই ডাকুন না কেন।