-273ºc,
Saturday, 3rd June, 2023 3:05 am
রূপেন্দু দাস
‘বিপুল তরঙ্গ রে…
তাই দুলিছে দিনকর চন্দ্র তারা
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা
আকুল চঞ্চল নাচে সংসারে…’
আক্ষরিক অর্থেই বিপুল। আর সে তরঙ্গের ধাক্কায় গোটা বিশ্ব দুলে উঠেছে। মৃত্যু আর কোনও ভাবনা বা ভয় আমাদের কারও নেই। এ এক অসহায় মৃত্যুময় বিভীষিকা। এই বিভীষিকা মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার কথা –
‘এ কী অন্ধকার ভারতভূমি/ বুঝি পিতা, তার ছেড়ে গেছ তুমি/ প্রতি পলে পলে ডুবে রসাতলে/ কে তারে উদ্ধার করিবে।’
সত্যি তো, কে কাকে উদ্ধার করবে। এ এমন রোগ, যাকে স্পর্শ করে সে হয়ে ওঠে অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলাই দস্তুর। আর এই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে একসময় বিশ্ব দুলে উঠেছিল।
রোগাক্রান্তের পাশে নিকটজনের থাকাটাই দস্তুর। কিন্তু এ রোগা তৈরি করে এক সামাজিক দূরত্ব। লক্ষ যোনী ভ্রমণ করে পাওয়া এ মানবজীবন অভিশপ্ত মনে হয়। কয়েক বছর আগে মুখ ঢেকে গিয়েছিল বিজ্ঞাপনে।
আর এখন মুখ ঢাকে প্লাস্টিকে মোড়া লাশ আর মৃত মানুষের গণচিতা। অক্সিজেন নেই। ভ্যাকসিনের জন্য সরীসৃপ পরীক্ষা। হতাশা আর হাহাকার। দয়ার বদলে দেখা গিয়েছে ব্যর্থ নির্দয়তা। কারণ, মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যুময়তার মধ্যে মৃত্যুহীনতার কথা, অনন্ত জীবনের মধ্যে শ্লেষময় সংকেত।
কিছুদিন আগে বহু ঘোষিত, বহু চর্চিত খেলাটা শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন বল গেম। মৃত্যুর প্রারম্ভিক ছোবলের হাত থেকে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়ছিল, তারা এখন সেই ছোবলের নিশানায়।
যা আরও বেশি বেদনায়দায়ক, তা হল তথাকথিত স্বঘোষিত গডম্যানদের লানাবিধ উপদেশাবলী। সন্ধ্যা হলেই তারা টিভির পর্দায় হাজির। সঙ্গে অবশ্যই নোটবুক আর পেন্সিল। নোটবুক ভরে উঠেছে হিজিবিজি লেখায়। কে কত বড়ো বিশেষজ্ঞ (পড়ুন বিশেষভাবে অজ্ঞ) তা প্রমাণ করতে শুরু হয়েছে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা, যে প্রতিযোগিতার কাছে লজ্জায় মুখ ঢাকছে করোনা আর ওমিক্রন।
সে জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে পরের দিন বাড়ির নিকটবর্তী ওষুধের দোকানের দরজায় টোকা। কারণ, মৃত্যুভয়। জীবনের মায়া কার নেই। সব কিছু দেখে বাদল সরকারর ত্রিংশ শতাব্দী নাটকের বাংলার অধ্যাপক শরৎ চোধুরীর সেই সংলাপের কথা মনে পড়ে – ভয়ে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়, ভয়ে মানুষের চেতনা জাগে। আর এই ভয়ে মানুষ পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
ভয়। মৃত্যুভয়। আর তা আরও ভয়াল করে তুলেছে তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ। শোনার পর একটাই প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় – আমারেও ধরিল কি ও রোগে। বিশেষজ্ঞরা শোধায় – এ হল ভ্যাকসিনের বিশ্বরূপ দর্শন। তুমি একবারের জন্য ঘাবড়ে যেও না। কুরুক্ষেত্রের কথা একবার মনে করে। তুমি হইলে গিয়া বিপন্ন অর্জুন। আর ভ্যাকসিন বংশীধারী কৃষ্ণ।
একটা শব্দের এমন অভিঘাত ভাবাই যায় না।
আসলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র রেলিংয়ের ওপর ঝুলছে। আর তার সুযোগ নিয়ে এই সব বিশেষজ্ঞরা মুখে ফেসপাউডার মেখে পর্দার সামনে হাজির। একের পর এক সতর্কবাণী। আর সুযোগসন্ধানি ঝোপ বুঝে কোপ মারতে উদ্যত। এমন মওকা আবার কবে আসবে। আর এসব ‘ডাক্তারবাবুদের কথা শুনে মানুষ পড়েছে মহাফ্যাসাদে। নেব কি সেকেন্ড ডোজ? না কি বেনেফিট অব ডাউটের ওপর ছেড়ে দেব।’
সত্য সেলুকাস। কী বিচিত্র এ দেশ।