নিজস্ব প্রতিনিধি: ‘লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে, মৎস্য মারিব খাইব সুখে’— সেই মধ্যযুগ থেকে পরিচিত এই শ্লোক।
রসনা প্রিয় হিসেবে বাঙালির পরিচয় গোটা দুনিয়াজুড়ে। বিশেষ করে বাঙালি আর মাছ ভাত-কার্যত যুগের পর যুগ ধরে সমার্থক হয়ে উঠেছে। আর ঘটি হোক কিংবা বাঙাল- প্রিয় মাছের তালিকায় ইলিশ থাকবেই। আর সেই যদি হয় পদ্মাপারের তাহলে তো সোনায় সোহাগা। বর্ষা পড়তেই বাজারে-বাজারে বাঙালি খোঁজ নিতে শুরু করে রূপালি শস্যের। অবশ্য পূর্ববঙ্গের অনেক বাঙালিই বিজয়া দশমীর পরে অবশ্য সস্তা হলেও ইলিশ ঘরে তোলেন না। সরস্বতী পুজোর দিন অর্থাৎ বসন্ত পঞ্চমীর দিন জোরা ইলিশ কুলোয় করে বরণ করে ঘরে তোলেন। অবশ্য অনেকেই সাধ থাকলেও সাধ্যে না কুলানোয় সেই রীতি বিসর্জন দিয়েছেন।
তা যে কথা বলছিলাম। মৎস্যপ্রেমী থুড়ি ইলিশ প্রেমী বাঙালিকে পদ্মাপারের রূপালি শস্যের স্বাদ পেতে আরও একটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। যদি অবশ্য সামনের বছর বর্ষার শেষে শেখ হাসিনা সরকার ফের পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়! বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজোর কথা মাথায় রেখে চলতি বছর বাংলাদেশ সরকার দু’দফায় প্রায় ৪৬০০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দিয়েছিল। গত বছর রফতানির অঙ্কটা ছিল ২০০০ মেট্রিক টনের মতো। অর্থাৎ এবছর এপার বাংলার কপালে বরাদ্দ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব মাছ এপার বাংলার বাজারে এসে পৌঁছয়নি। অনুমোদনের অর্ধেকের সামান্য বেশি মাছ এসে পৌঁছেছিল হাওড়া, মানিকতলা, লেক মার্কেট সহ বিভিন্ন বাজারে। কিন্তু সেই মাছ কিনতে গিয়ে হাতে এবং পকেটে ছ্যাঁকা লেগেছিল সাধারণ মানুষের।
অধিকাংশের মুখে একই কথা, ‘কোথায় আর বাংলাদেশের ইলিশ খেলাম? খবরের কাগজেই শুধু ইলিশ আসার খবর পড়লাম। মাঝে কিছু দিন বাজারে দেখলাম বটে। কিন্তু দেড় বিদ্দা ইলিশের যা দাম চাইল, সে তো মধ্যবিত্তের হেঁসেলে ঢোকার উপায় নেই।’ ইলিশ রসিকদের কাছে খবর ছিল, এ বছর বরিশালের কাছে মনপুরা, তাজিমুদ্দিন, পাথরঘাটা, মহীপুরের সুস্বাদু ইলিশ আসবে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু বাজারে গিয়ে কোনটা বাংলাদেশের আর কোনটা ডায়মন্ডহারবারের, তা বোঝার উপায় ছিল না খাদ্য রসিকদের। তাই পরিচিত মাছ বিক্রেতা বাংলাদেশের ইলিশ বলে ব্যাগে যা পুরে দিয়েছে, তাই নিয়ে এসে বাড়িতে গিন্নিকে সর্ষে ইলিশ বানানোর অনুরোধ করেছেন কলকাতার বাবুরা। দামের ছ্যাঁকা খেয়ে হাত পুড়েছে বটে, তবু বাড়িতে এসে বাংলাদেশের ইলিশ নিয়ে এলাম বলাতেই যেন পুজোর আনন্দ আরও খানিকটা বেড়ে গিয়েছিল। অনেকে এমনও বলেছেন, হাসিনা সরকার আরও একটু নরম হলেই তো পারেন। নিজের দেশের ইলিশ সে তো বাঙালিকেই খেতে পাঠাবেন। এতো কৃপণ হলে চলে?
নিন্দুকেরা অবশ্য অনেকেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বলে যা খেলাম, কই তার স্বাদ তো সেরকম কিছু নয়! কি জানি বাপু। এতো দাম দিয়ে ইলিশ কেনাটা দেখছি মাঠে মারা গেল।’ কেউ-কেউ বলছেন, ‘আরে ওপার বাংলার আসল ইলিশগুলো সব এখনকার মালদার মাছ ব্যবসায়ীদের সৌজন্যে কোল্ডস্টোরেজে ঢুকে গিয়েছে। শীত, গ্রীষ্মে এলেই দেখবেন সেই সব মাছ আরও চড়া দামে বিক্রি করবে। মধ্যবিত্ত বাঙালির ‘ঠোকা’ কপাল, বুঝলেন দাদা!’
আসলে, কলকাতার বাজারে এ বছর এক কেজির উপর ইলিশ ১৪০০ -১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ডিম ভর্তি একটু গোলগাল স্বাস্থ্যবান ইলিশের দাম ছিল আরও একটু উপরের দিকে। আর দুটো ইলিশ ৮০০ গ্রাম ওজন হবে এমন মাছের দাম গিয়েছে, ৭০০ – ৮০০ টাকা কেজি। আর ডায়মন্ডহারবারের কাঁচা মাছ বলে কলকাতার বাজারগুলোতে ৪০০ – ৫০০ গ্রামের যে সব মাছ বিক্রি হয়েছে, তার দামও ৮০০ টাকার আশেপাশেই ঘোরা ফেরা করেছে। ফলে অনেকেই একটু ভয়ে ভয়েই দু একদিন সেই সব মাছ কিনে খেয়েই নিজের মনকে সান্তনা দিয়েছে। খেয়ে সেই রকম মনও ভরেনি। আর ডায়মন্ডে এ বছর সেরকম ইলিশ ধরাও পড়েনি। তাই এপার বাংলা, ওপার বাংলা মিলিয়ে বাঙালির এ বছরের ইলিশ পার্বণ কোনও রকমে উতরে গেলেও, স্বাদের অভাবটা রয়েই গিয়েছে। ভাই ফোঁটাতেও অনেক ভাইয়ের পাতে ভাঁপা ইলিশ পড়েছে। কচুর শাকে ইলিশের মাথা পড়েছে অনেক বাঙাল বাড়িতেও। দু একজন রসিক মানুষ ইলিশ ভাজা, ইলিশের তেল, ডিম – সহ গলাধঃকরণ করে দুপুরের ভাত ঘুম দিয়েছেন। সব মিলিয়ে দুই বাংলার ইলিশ মিলেমিশে বাঙালির বর্ষা ও দুর্গোৎসব পার করে দিয়ে আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে।
বাঙালিরও বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষ পেরিয়ে গেলেই এ বছরের মতো উৎসব মিটবে। তারপর শুরু হবে দিন গোনা। ইলিশের স্বাদ পাওয়ার।