রূপেন্দু দাস
‘ওই শুনি যেন চরণধ্বনিরে, শুনি আপনমনে’
তিনি শুনতে পেয়েছিলেন সে চরণধ্বনি। প্রথম আক্রমণের দিন থেকে। তাই, শেষ মুহূর্তে সজ্ঞানে তাঁর মুখোমুখি হতে চান। তার রূপ থাকলে তিনি দেখবেন। তার কণ্ঠস্বর থাকলে সে কণ্ঠস্বর তিনি শুনবেন। তাঁর গন্ধ থাকলে সে স্পর্শ তিনি অনুভব করবেন। সে আসছে তিনি জানেন।
‘স্বচ্ছন্দ মরণং তুষ্ট, দদৌ তস্মৈ মহাত্মনে’
আতরবউ মশাইয়ের মুখখানি ধরে বললেন
– ধ্যান সাঙ্গ হল। মাধবের চরণাশ্রয়ে শান্তি পেলেন।
শান্ত আত্মসমর্পণের মতো তিনি স্বামীর বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন।
মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।
মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ। মৃত্যুকে সাড়ম্বরে বরণ করে নেওয়া। মৃত্যু ধ্রুব, মৃত্যু সত্য, মৃত্যু অনিত্য।
কার জীবনে মৃত্যু কীভাবে উপস্থিত হয়, তা আমরা কেউ জানিনা। সে আসে বিনা ঘোষণাতেই। কখনও তাকে আমন্ত্রণ করা হয়। অনিবার্যকে মেনে নেওয়া কঠিন। তবুও…
যেমনটা এসেছিল আরোগ্য নিকেতনের মশাইয়ের জীবনে। আর সে আসছে জেনে জীবন মশাই শেষ মুহুর্তে তাঁর মুখোমুখি হতে চাইছেন।
কিন্তু কেন?
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’
যদি সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা মানুষের অধিকার হতে পারে, তাহলে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ায় তার অধিকার হতে পারে। যে অধিকারের অধিকারী হয়েছিলেন পিতামহ ভীষ্ম।
‘মধুর কোমল স্বর অতীব গভীর
কহিতে লাগিল বীর চাহি যুধিষ্ঠির
এই যে দক্ষিণায়ন আছে যতদিন
ততদন শরীর না হবে প্রভাহীন
বল পরাক্রম যত সব পরিহরি
শরীর না ছাড়ি আমি প্রাণমাত্র ধরি।
সে করুণামৃত্যুর ছবি ধরা হবে এখানে।
কাকে বলে স্বেচ্ছামৃত্যু?
The act of practice, of ending life of a person who is suffering from incurable and often painfull or distressing illness.
যে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে এত বিতর্ক, সেই স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্ম দিয়েছিল মহাভারত। মহাভারত রচনা না হলে পৃথিবীতে ইচ্ছামৃত্যু শব্দটার জন্মই হত না। মৃত্যুর অধিকার শুধু দার্শনিক প্রমত্ততা না কি স্বাধীকার, তা নিয়ে তর্ক বেঁধে যাবে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির পরেও মানুষ চায় না যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে। আমরা যেহেতু প্রকৃতির সন্তান, তাই প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণের একটা গোপন ইচ্ছা আমাদের মনে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-
‘মৃত্যু আমাদের কাছে অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।… মৃত্যু পুরাতনকে অপসারিত করে দেয়… যেমন অন্ধকার রাত্রেই আকাশে অসীম জগতের আভাস দেখা দেয়। তেমনি মৃত্যুতে অনন্তের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ অনুভব এবং অনুমান করি। যদি মৃত্যু না থাকত, তাহলে আপনার দীনহীন অস্তিত্বের মধ্যে সুকঠিনভাবে বদ্ধ হয়ে থাকতুম। মৃত্যুতে যেমন আমাদের জীবনকে একদিকে সীমাবদ্ধ করে তেমনি সেই মৃত্যুতে আমাদের জীবনকে আর একদিকে সীমামুক্ত করে দেয়।’
স্বেচ্ছামৃত্যুর মূলে মূলত তিনটি যুক্তি
মৃত্যুর অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার
মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ অর্থহীন। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তিদান চিকিৎসকদের কর্তব্য এবং দায়িত্ব
কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্যে যদি রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং যন্ত্র বন্ধ করলে যদি রোগী মারা যান, তাহলে সে যন্ত্রণা বন্ধ করাও ইউথানাসিয়ার সামিল। চিকিৎসকেরা অনেক সময় সেটাও করেছেন।
করুণামৃত্যুর আকাঙ্খার মূলে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি, যা এই শতাব্দিতে আরও প্রগাঢ়।
শেষ করি রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে-
‘খণ্ডতার মধ্যে কদর্যতা, সৌন্দর্য একের মধ্যে, খণ্ডতার মধ্যে প্রয়াস, শান্তি একের মধ্যে, খণ্ডতার মধ্যে বিরোধ, মঙ্গল একের মধ্যে, তেমন খণ্ডতার মধ্যে মৃত্যু, অমৃত সেই একের মধ্যে।’