নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা: একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরেই কানে ভেসে আসে সেই কালজয়ী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি?’ ওই গানের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা আন্দোলন বাঁচিয়ে রাখার জন্য আত্মবলিদান দেওয়া ভাষা শহিদদের স্মরণ করে আজকের প্রজন্ম। বৃহস্পতিবার ভোরেই সুদূর লন্ডনে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন কালজয়ী গানের রচয়িতা তথা বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। একটি মাত্র গান লিখে আর কোন কবি কিংবা গীতিকার অমর হয়েছেন কিনা জানা নেই। যে গান লিখে অমর হয়েছেন গাফফার চৌধুরী, সেই গানের প্রেক্ষাপট জানেন কী?
ভাষা আন্দোলনের সময়ে ঢাকা কলেজে পড়তেন আঠেরো বছরের গাফফার চৌধুরী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর খবর পেয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান খোঁজ নিতে। সেই সময় আউটডোরে এক নিহত ছাত্রের লাশ দেখে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশের গুলিতে ছাত্রটির মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। নিথর দেহটি ছিল শহিদ রফিকউদ্দিনের। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আর বর্বরোচিত গুলি কাণ্ডের প্রতিবাদে রাজপথে মিছিলে সামিল হয়েছিল লাখো জনতা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গাফফার চৌধুরীও। মিছিলে বেধড়ক লাঠি চালায় পুলিশ। লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
আহত অবস্থাতেই লিখে ফেলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সঙ্কলনে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেই সঙ্কলন বাতিল করে পাক সরকার। পরে এক ইশতেহারে গানটি ছাপানো হয়। প্রথমে বিখ্যাত সুরকার আবদুল লতিফ কবিতাটির সুরারোপ করেন এবং ১৯৫৩ সালে গুলিস্তানের ব্রিটেনিয়া হলে ঢাকা কলেজের নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ ও আতিকুল ইসলাম প্রথম গানটি পরিবেশন করেন।
তবে শব্দ আর সুরের মূর্ছনায় আমাদের মানসপটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষাশহিদদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে যে গান তার সুরারোপ করেছিলেন কিংবদন্তি সুরকার আলতাফ মাহমুদ। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গান ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। নিচে সম্পূর্ণ গানটি তুলে ধরা হল—
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।