নিজস্ব প্রতিনিধি, কোচবিহার: বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নরূপে অবতীর্ণ হন মা দুর্গা। কোথাও বাসন্তী, কোথাও ছিন্নমস্তা, কখনও বা বগলা। ঠিক সেভাবেই কোচবিহারের রাজবাড়িতে ‘বড়দেবী’ নামে অবতীর্ণ হন দেবী দুর্গা। এখানে দুর্গার সঙ্গে থাকেন না লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। প্রতিমার দু’পাশে থাকে জয়া ও বিজয়া। রক্তবর্ণ দেবী আজও নররক্তেই তুষ্ট হন। আর নিয়ম মেনে আজও চলে গুপ্তপুজো।
কথিত আছে, কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসিংহ ছেলেবেলায় তাঁর তিন ভাই শিষ্যসিংহ, চন্দন ও মদন এবং খেলার সঙ্গীদের নিয়ে ১৫১০ সালে অসমের ‘চিকনা’ নামক গভীর বনে ময়না কাঠের ডালকে দেবী দূর্গা কল্পনা করে পুজো করেছিলেন। ওই পুজোতেই এক বন্ধুকে পাঠার ন্যায় কাল্পনিক হাড়িকাঠে আটকে রাখা হয়েছিল। বিশ্বসিংহ কুশ দিয়ে তাকে আঘাত করা মাত্রই ধর থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। মনে করা হয়েছিল দেবীর অলৌকিক ক্ষমতাবলেই তা হয়েছে। এরপর ওই মৃত বন্ধুর নাথা দেবীর কাছে নিবেদন করা হবয়েছিল। কথিত আছে, তার পরে পরেই চিকনার অধিপতি তুরকা কোতোয়ালকে পরাজিত করে কোচবিহারের সিংহাসনে বসেছিলেন বিশ্বসিংহ। তার বেশ কয়েকবছর পর মহারাজা বিশ্বসিংহের পুত্র কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নর নারায়ণ স্বপ্নাদেশে স্ববংশে দশভুজা দূর্গা মূর্তির পূজার প্রচলন করেন। তবে কুলদেবী প্রাচীন অষ্টধাতুর শ্রী শ্রী ভবানী দুর্গার দেবীর অনুকরণেই প্রতি বছর মাটির মূর্তি তৈরি করা হয়।
কোচবিহার রাজবাড়ি বড়দেবী দুর্গার চেহারা উদ্রেককারী। তাঁর গাত্রবর্ণ লাল, অসুরের গাত্রবর্ণ সবুজ। দেবীর বাহন সিংহ ও বাঘ। অসুরের পায়ে কামড়ে ধরে থাকে সিংহ আর অসুরের হাতে কামড় বসিয়ে থাকে বাঘ। মহালয়ার পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বড়দেবী দূর্গা পুজো। মহাষষ্ঠীর দিন থেকে পুজো পুরোমাত্রায়। কথিত রয়েছে, একদা রাজবাড়িতে নরবলির প্রচলণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নরবলির বীভৎসতা দেখে কোচবিহারের ১৯তম কোচ মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ ভূপ পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে নরবলি বন্ধ করে দেন। যদিও বড়দেবী নররক্ত ছাড়া পুজো না নেওয়ায় প্রতি বছর অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাতে এখানে এক বিশেষ ধরনের বলির ব্যবস্থা করা হয়। সেসময় বাইরের কেউ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে না। কামসানাইট উপাধিধারী প্রতিনিধি তাঁর আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর পদতলে। বলি দেওয়া হয় চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মানুষের প্রতীক একটি পুতুলকে। উচ্চস্বরে বাজে ঢাক। এই পুজোকেই ‘গুপ্তপুজো’ বলা হয়। যে রীতির বদল হয়নি আজও। অন্যদিকে যেহেতু মনে করা হয় ময়না গাছের ডালকেই প্রথম দেবীরূপে পুজো করা হয়েছিল, তাই আজও ময়না গাছের ডাল রাধাঅষ্টমীর পুন্যতিথিতে পুজো করে দেবীপ্রতিমার শক্তিগোজ করা হয়।