এই মুহূর্তে




কালাপাহাড় পুড়িয়ে ফেলেছিলেন জগন্নাথ বিগ্রহ !  জানুন অজানা কাহিনী




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায়প্রাচীন হিন্দু মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হলেই একটি নামই অবধারিত ভাবে উঠে আসে‚ তা হল কালাপাহাড়। বাস্তবিকই তাঁর হাতে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য হিন্দু দেবালয়। বাংলা ও ওড়িশার বহু মন্দির‚ বিগ্রহ ধ্বংস করেছিল সে। কিন্তু, কে ছিল এই কালাপাহাড় ? কেনই বা তিনি   মন্দির ধ্বংস করতেন ?

আসলে কালাপাহাড় ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু ব্রাহ্মণ। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, মতান্তরে নওগাঁ জেলার বীরজোয়ান গ্রামে ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক কট্টর ব্রাহ্মন পরিবারে তার জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল ‘রাজীবলোচন রায়’ ওরফে ‘রাজু ভাদুড়ী’। রাজীবলোচনের অপর একটি নাম ছিল কালাচাঁদ। জানা যায় যে, রায় ছিল তাঁদের পারিবারিক উপাধী ও তাঁদের আসল পদবি ছিল ভাদুড়ী। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায়, সে সময়ে শেরশাহের স্বদেশী সেনাপতি সুলেমান খান কররানি বাংলা অধিকার করে নিয়েছিলেন। কররানি যখন গৌড়ের শাসক ছিলেন ঠিক সেই সময়ে রাজীবলোচন গৌড়ের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন, এবং অতি অল্পকালের মধ্যেই যুদ্ধবিদ্যায় নিজের পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে শাসকের সুনজরে পড়েছিলেন। তবে কি ভাবে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ?

জনশ্রুতি আছে, কররানি রাজীবলোচনকে তাঁর সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ করার ও গৌড়ের সেনাপতি পদের লোভ দেখিয়েছিলেন । তিনি রাজীবকে  স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন যে, রাজীবকে তার দরকার, তবে সেক্ষেত্রে দুটি শর্ত রয়েছে –  রাজীবকে গৃহত্যাগী হতে হবে এবং ধর্মান্তরিত হতে হবে। সেই প্রস্তাব শুনে আপাতদৃষ্টিতে রাজীব হতভম্ভ হলেও লোভের বশবর্তী হয়ে রাজীবলোচন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কররানির কন্যাকে বিবাহ করে গৌড়ের সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তবে মুসলমান ধর্ম নেওয়ার পর রাজীবলোচন সুখী ছিলেন না। তাই তিনি পুরীতে এসে পতিতপাবন শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুকে দর্শন করে নিজের কৃতকর্মের পাপ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। তখন রাজীব মুক্তিমণ্ডপের পণ্ডিতদের কাছে হাতজোড় করে ধর্ম পরিবর্তনের পাপ স্বীকার করায় পণ্ডিতরা তাঁকে কটু ভাষায় অপমান করেন ও মন্দিরের বাইরে বের করে দেন।

আর সেই প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘মহম্মদ ফর্ম্মুলি’ নাম নিয়েছিলেন এবং প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন।  তখন থেকেই তাঁকে ‘কালাপাহাড়’ নামে ডাকা হত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি একচেটিয়া দেশের সব ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দিরের অজস্র ক্ষতিসাধন করেছিলেন। আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত খুব কম মন্দিরই তাঁর গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এককথায় তিনি ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন।

ঐতিহাসিক নিয়ামতউল্লার ‘মাকজান-ই-আফগানি’ গ্রন্থে কালাপাহাড়ের শ্রীজগন্নাথ মন্দির আক্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। কালাপাহাড়  শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের দিকে আসছে শুনে মন্দিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ প্রতিনিধি দিব্যসিংহ পট্টনায়ক জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহগুলিকে চিল্কা হ্রদের ছাপলি হাতিপাড়া নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে লুকিয়ে রেখেছিলেন।  কালাপাহাড় সৈন্যসামন্ত নিয়ে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি তাঁর নজরে পড়েনি। পুরীর ব্রহ্মগিরি অঞ্চলের গড় কোকালা নামে এক গ্রামের প্রধান দনপাহন্ত সিমহা জানতেন সেই ছাপলি হাতিপাড়া গ্রামের কথা। তিনিই কালাপাহাড়কে জায়গাটি চিনিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য পরে বিশ্বাসঘাতক দনপাহন্তকে পুরীতে দুটি বড় জায়গির দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন কালাপাহাড়। খুরদায় আবিষ্কৃত তালপাতার পুঁথিতে কালাপাহাড়ের পুরী আক্রমণের উল্লেখ রয়েছে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-তেও এই জঘন্য আক্রমণের কথা জানা যায়।

শোনা যায়,কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহ তিনটিকে সর্বসমক্ষে হাতির পিঠে চাপিয়ে পুরীতে নিয়ে এসেছিল। কালাপাহাড় উড়িষ্যাবাসীকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে সমগ্র উড়িষ্যা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর সর্বশক্তিমান জগন্নাথদেবও তাঁর হাতে বন্দি। জগন্নাথদেবের রত্নভাণ্ডার তছনছ করে আজকের হিসেবে কয়েক কোটি কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার ও হীরে-জহরত লুট করেছিলেন কালাপাহাড়। জগন্নাথ মন্দির বিশেষ ধরনের অত্যন্ত শক্ত উৎকৃষ্ট ‘খোণ্ডালাইট’ পাথরে নির্মিত বলে এই মন্দিরটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করা কালাপাহাড়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই মন্দির ধ্বংস করতে না পেরে রাগে অন্ধ কালাপাহাড় মন্দিরের গায়ে বেশ কিছু অমূল্য ভাস্কর্যের ক্ষতি করেছিলেন ।

জানা যায়, মুক্তিমণ্ডপের পাশে থাকা পবিত্র কল্পবটের গোড়াসুদ্ধ উৎপাটন করেছিলেন কালাপাহাড় ও সেই গাছটিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে জগন্নাথদেবের প্রতীক হল কল্পবট। এরপর জগন্নাথ- বলরাম-সুভদ্রার দারুমূর্তি বাংলায় নিয়ে এসে নিজের পায়ের তলায় পিষ্ট করে গঙ্গার ধারে আগুন জ্বালিয়ে বিগ্রহ তিনটিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন ও অর্ধদগ্ধ অবস্থায় ত্রিমূর্তিকে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন। সে সময় বিসরা মহান্তি নামে এক সাহসী জগন্নাথভক্ত ছদ্মবেশে কালাপাহাড়কে অনুসরণ করেছিলেন। তিনিই তখন শ্রী জগন্নাথের ‘ব্রহ্ম’ উদ্ধার করে খুব গোপনে উড়িষ্যার কুজঙ্গগড় নামে এক জায়গায় নিয়ে যান। সেখানে ‘ওলিয়া’-র উপর রেখে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই ব্রহ্মবস্তুর পুজো-অর্চনা শুরু হয়। ‘মাকজান-ই-আফগানি’ ও ‘আইন-ই-আকবরি’ এই দুটি গ্রন্থেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি পুড়িয়ে ফেলার কথা লেখা আছে।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও কোনারকের সূর্যমন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, ময়ূরভঞ্জের মন্দির ও মেদিনীপুরের মন্দিরগুলিও তাঁর আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মন্দিরের প্রতিমা ধ্বংস ও ধনসম্পদ লুটপাট – উভয় দিকেই তিনি প্রবল আগ্রহী ছিলেন।

মোঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে কালাপাহাড় আমৃত্যু সংগ্রাম করে গিয়েছিলেন। বঙ্গদেশ ও বিহারে আকবরের বিরুদ্ধে আফগানদের যে বিদ্রোহ হয়েছিল, কালাপাহাড় তাতে যোগদান করেছিলেন, এবং অনুমান করা হয় যে, তিনি সেই যুদ্ধেই নিহত হয়েছিলেন (এপ্রিল ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দ)। মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পরে তাঁকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

দুর্গাপুজোয় কোন রঙের জামা পড়বেন ? রাশি মিলিয়ে বেছে নিন! কাটবে সংকট

প্রতিবন্ধী ছাত্রীকে হুইল চেয়ার দিয়ে স্কুলে আসতে সাহায্য করলেন প্রধান শিক্ষক, আনন্দে হল ভুরিভোজ

Mahalaya : মহালয়া  শুভ না অশুভ? বিচার করুন নিজেই

Vishwakarma Puja 2024: কবে হবে বিশ্বকর্মা পুজো ? জেনে নিন শুভ সময়

Mahalaya : আসলে কি এই মহালয়া? জানুন দেবী দুর্গার সাথে এর সম্পর্ক

এবছর দেবী দূর্গা আসছে কীসে ? অশুভ ইঙ্গিত বহন করেছে না তো ?

Advertisement

এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ

দার্জিলিং

কালিম্পং

জলপাইগুড়ি

আলিপুরদুয়ার

কোচবিহার

উত্তর দিনাজপুর

দক্ষিণ দিনাজপুর

মালদা

মুর্শিদাবাদ

নদিয়া

পূর্ব বর্ধমান

বীরভূম

পশ্চিম বর্ধমান

বাঁকুড়া

পুরুলিয়া

ঝাড়গ্রাম

পশ্চিম মেদিনীপুর

হুগলি

উত্তর চব্বিশ পরগনা

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

হাওড়া

পূর্ব মেদিনীপুর