এই মুহূর্তে




চেনেন কী ‘মৌমাছির দেবী’কে? জেনে নিন দেবী ভ্রামরীর অজানা কাহিনি




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : পরমাপ্রকৃতি ভগবতী দেবী পার্বতীর এক বিশেষ রূপ হলেন  ভ্রামরীযিনি হিন্দু ধর্মে এক অনন্য এবং তান্ত্রিক শক্তির প্রতীক। ‘ভ্রামরী’ শব্দের অর্থ “মৌমাছি” বা “ভ্রমর”। দেবী এই রূপে অরুণাসুর নামক এক দুর্ধর্ষ অসুরকে বধ করেন, এবং তাঁর উপাসনা শক্তি, সুরক্ষা এবং ভয় নাশের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। কথিত আছে,  তিনি ‘মৌমাছির দেবী’ নামেও পরিচিত এবং তাঁর সঙ্গে মৌমাছির গুঞ্জন, আক্রমণশীলতা ও সুরক্ষার প্রতীকী সংযোগ রয়েছে।

দেবীর নামের অর্থ

ভ্রামরী = ভ্রমর (মৌমাছি) + ঈ (স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়) = “ভ্রমরের রূপে অধিষ্ঠানকারী দেবী”।

জানা যায়, তিনি ভ্রমরম্বা, চিত্রভ্রমর সঙ্কাশা, মহামারী ইত্যাদি নামেও পরিচিত ।

পৌরাণিক কাহিনি: অরুণাসুর বধ

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী ভ্রামরীর জন্ম ও আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট গঠিত হয় অরুণাসুর নামে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী অসুরের কারণে। পুরাণ মতে, অরুণাসুর হিমালয়ে গঙ্গার তীরে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছ থেকে বর প্রাপ্ত হন যে, কোন অস্ত্র, মানুষ, নারী বা সাধারণ জীব, এমনকি দ্বিমুখী/চতুর্মুখী জীব দ্বারা তাঁর মৃত্যু হবে না। এই বর পেয়ে সে দেবতাদের রাজ্য আক্রমণ করে, সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, যম ইত্যাদি দেবতাদের স্থানচ্যুত করে স্বর্গ দখল করে নেয়। শেষ পর্যন্ত অসহায় দেবতারা আশ্রয় নেন মহাদেব ও আদ্যাশক্তির কাছে। আদি শক্তি দেবী পার্বতী তখন ভ্রামরী রূপ ধারণ করেন। তাঁর চার হাত থেকে অগণিত মৌমাছি, শিংগা, মাছি, মশা ও পোকামাকড় বের হয়ে এক বিশাল আকার ধারণ করে।

অতঃপর, এই ভয়ঙ্কর রূপে ভ্রামরী দেবী সমস্ত অসুর সেনা এবং অরুণাসুরকে ভয়ানক বিষাক্ত দংশনে পরাজিত ও ধ্বংস করেন। তাঁর শরীরজুড়ে থাকা পোকামাকড় গর্জন করতে করতে আক্রমণ চালায় এবং একে একে অসুর বাহিনীকে ধ্বংস করে। শেষে অরুণাসুরও বিনষ্ট হয়। এরপর সমস্ত কীটপতঙ্গ আবার দেবীর শরীরে মিশে যায়। এইরূপে, ভ্রামরী দেবী হলেন আক্রমণাত্মক রূপে মা দুর্গার এক তান্ত্রিক প্রতিফলন, যিনি অশুভতা ও অহংকার ধ্বংসে অপ্রতিরোধ্য।

মূর্তিতত্ত্ব ও ধ্যানমন্ত্র তত্ত্ব

ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী, ভ্রামরী দেবী হলেন:

  • কোটি সূর্যের মতো দীপ্তিমান।
  • কোটি কামদেবের থেকেও সৌন্দর্যময়ী।
  • অলঙ্কারে ভূষিতা, গলায় ফুলের মালা।
  • চতুর্ভুজা, হাতে বর, অভয়, অঙ্কুশ ও পাশ।
  • তাঁর শরীর ও আশেপাশে ভ্রমরের গুঞ্জন।
  • রুদ্ররূপে অসুরনাশিনী, শান্তরূপে করুণাময়ী মাতৃস্বরূপা।
  • তিনি অসুরনাশক তাণ্ডবী রূপে যেমন তেজস্বিনী, তেমনই ভক্তদের প্রতি দয়াময়ী ও বরদাত্রী।

শক্তিপীঠ ও মন্দির

  • ভ্রমরম্বা শক্তিপীঠ এবং মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ—দুই মহান তীর্থস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের কুরনুল জেলার শ্রীশৈলম অঞ্চলে অবস্থিত।
  • এটি ১৮টি মহাশক্তিপীঠের অন্যতম।
  • এখানে দেবী ভ্রমরম্বিকা নামে পূজিতা হন।
  • বিশ্বাস করা হয়, সতীর জরায়ু এখানে পতিত হয়েছিল।
  • ভগবান শিব এখানে মল্লিকার্জুন রূপে পূজিত, এবং তাঁর ভৈরব রূপ হলেন শম্বরানন্দ।

জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি ব্লকের শালবাড়ি অঞ্চলেও এক প্রাচীন ভ্রামরী মন্দির আছে। তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দিরেও সতীর ডান পা পতিত হয়েছে বলে লোকবিশ্বাস প্রচলিত। এটি একটি জাগ্রত পীঠ বলে মানা হয়।

প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ ও উল্লেখ

ভ্রামরী দেবীকে নিয়ে বিশদ আলোচনা পাওয়া যায়:

দেবী ভাগবত পুরাণে (দশম গ্রন্থ, ত্রয়োদশ অধ্যায়)

এখানে তিনি লক্ষ্মীর প্রতিরূপ রূপে বর্ণিত, যিনি অসংখ্য অসুরবিনাশে সহায়ক ছিলেন: যেমন বৃত্রাসুর, রক্তবীজ, শুম্ভ-নিশুম্ভ, ধুম্রলোচন প্রমুখ।

শাস্ত্র অনুসারে, দেবতারা তাঁকে প্রণাম করে বলেন:

“তুমি দুধসাগর থেকে লক্ষ্মীরূপে আবির্ভূত হয়েছ, তুমি রক্তবীজ, শুম্ভ-নিশুম্ভ, চণ্ড-মুণ্ড, ধূম্রলোচন প্রমুখ অসুরদের বধ করেছ।”

ভ্রমরী প্রাণায়াম: নামের আরেক তাৎপর্য

ভ্রমরী প্রাণায়াম হল একটি যোগব্যায়াম ও শ্বাসনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যেখানে শ্বাস ছাড়ার সময় মৌমাছির গুঞ্জনের মতো শব্দ করা হয়।

  • এটি মনকে শান্ত করে,
  • মানসিক চাপ হ্রাস করে,
  • ধ্যান, ঘুম ও মানসিক স্থিতি বৃদ্ধি করে।

এই প্রাণায়াম দেবী ভ্রামরীর নাম থেকেই অনুপ্রাণিত—যেহেতু তাঁর গুঞ্জনের শক্তি এবং ভ্রামরের প্রতীক মানবমনে গভীর প্রভাব ফেলে।

পূজা ও উপাসনা

  • ভ্রামরী দেবীর পূজা তান্ত্রিকভাবে এবং সাধারণভাবেও হয়।
  • ভয় থেকে রক্ষা, শত্রুদমন, রোগনাশ, ভয়মুক্তি, এবং শক্তির বৃদ্ধি—এই উদ্দেশ্যে ভক্তরা তাঁর শরণাপন্ন হন।
  • মল্লিকার্জুন-ভ্রমরম্বা মন্দিরে নিত্যপূজা, বিশেষ হোম, এবং নবরাত্রি সময়ে মহা আরতি ও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, ভ্রামরী দেবী শুধুমাত্র এক পৌরাণিক কাহিনির অসুরবিনাশিনী নন, তিনি হলেন এক তান্ত্রিক শক্তির মহাশক্তি যিনি জীবনের সমস্ত বিষ, অন্ধকার, অহংকার এবং ভয়কে ছিন্নভিন্ন করে দেন। তাঁর রূপ মাতৃস্নেহ ও যুদ্ধের তেজস্বরূপা—যিনি একাধারে করুণাময়ী, আবার অপরাধের বিনাশকারী। ভক্তদের কাছে তিনি ভয় দূরীকরণ, বিপদ থেকে মুক্তি এবং শক্তির আধার। শক্তিপীঠ ভ্রমরম্বা মন্দিরে তাঁর আরাধনা তান্ত্রিক সাধকদের জন্য একটি অমূল্য পথ এবং সাধারণ ভক্তদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

একদিনেই ৫ ড্রিমলাইনার বিমান উড়ান বাতিল এয়ার ইন্ডিয়ার, আতঙ্কিত যাত্রীরা

খামেনির দশা হবে সাদ্দাম হুসেনের থেকেও খারাপ, হুঙ্কার ইজরায়েলের

মুক্তিযুদ্ধে একাই খতম করেছিলেন ৬ রাজাকারকে, না ফেরার দেশে বীরাঙ্গনা সখিনা

বাড়িতে পৌঁছল ভেঙে পড়া বিমানের পাইলটের দেহ, কান্নায় ভেঙে পড়লেন বাবা

ব্যাডমিন্টন কোর্টে মানুষের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই AI রোবটের জিতল কে?

অপমৃত্যুজয়ী শক্তির দাত্রী রূপে পূজিতা হন এই দেবী, চেনেন নাকি?

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ