নিজস্ব প্রতিনিধি: কলেজের অস্তিত্ব শুধু খাতায়-কলমে। নেই তার কোনও ভবন, নেই কোনও অফিস, নেই কোনও ক্লাসরুমও। কার্যত বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্বই নেই! অথচ, ওই কলেজ থেকে বছর বছর ছাত্রছাত্রীরা Degree ‘অর্জন’ করছেন। আর সেই সব Degree দেখিয়ে তাঁরা স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষিকাও হয়ে গিয়েছেন। এই রকম এক আধটা কলেজ নয়। প্রায় ২ হাজার কলেজ রয়েছে এই বাংলায়। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ED’র আধিকারিকেরা বাংলাজুড়ে এইরকম ২ হাজারেরও বেশি বেসরকারি DL.ED ও B.ED কলেজের সন্ধান পেয়েছেন নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনায় তদন্তে নেমে। তাঁদের দাবি, ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে Degree প্রদানের প্রামাণ্য নথি তাঁদের হাতে রয়েছে। ভুয়ো কলেজ থেকে প্রাপ্ত ভুয়ো Degree দেখিয়েই বহু অযোগ্য চাকরিপ্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকা হয়েছেন বলেই এখন তাঁদের দাবি।
আরও পড়ুন Group-D’র শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করল SSC
DL.ED ও B.ED পাঠ্যক্রমে স্কুলে শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই কলেজে চালু করতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং কোনও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্র বা NOC’র প্রয়োজন হয়। তাই এই কলেজগুলি NOC’র পাওয়ার সময় যারা পর্ষদ আধিকারিক বা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, তাঁদের ভূমিকা এখন খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। ED’র আধিকারিকেরা তদন্তে নেমে জানতে পেরেছেন যে, পার্থ চট্টোপাধ্যায় যখন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন তখন রাজ্যে বেসরকারি DL.ED ও B.ED কলেজের সংখ্যা রাতারাতি তিন-চারগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ধৃত ছাত্রনেতা কুন্তল ঘোষ নিজে যেমন এই কারবার শুরু করেছিলেন, তেমনই এই পথে কোটি কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন অনেককে। তদন্তে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র থেকে ED’র আধিকারিকেরা নিশ্চিত হন, অস্তিত্বহীন এসব কলেজ থেকে DL.ED ও B.ED ডিগ্রি পেয়েছেন বহু অযোগ্য প্রার্থী। শুধু তাই নয়। এই কলেজগুলি দুর্নীতির অন্যতম আখড়া হয়ে উঠেছিল। টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি বিক্রি করেছে তারা। প্রাথমিকভাবে কিছু বিএড ও ডিএলএড কলেজের তালিকা নিয়ে জেলায় জেলায় খোঁজখবর শুরু হয়। তা করতে গিয়ে কার্যত তদন্তকারীদের চোখ কপালে ওঠে।
আরও পড়ুন মানুষের অভিযোগের কতটা নিষ্পত্তি হচ্ছে? খতিয়ে দেখতে সোমবার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী
তাঁরা দেখেন, নথিতে উল্লিখিত ঠিকানায় কলেজ তো দূরের কথা, কোনও বিল্ডিংয়েরই অস্তিত্ব নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পঠনপাঠনের বালাই ছিল না। তদন্তকারীদের দাবি, এই ভুয়ো কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য প্রার্থী পিছু প্রায় ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা করে নেওয়া হতো। তাঁদের বলে দেওয়া হতো, কোনও ক্লাস করতে হবে না। ছ’মাস অন্তর ডেকে হাজিরা খাতায় সই করিয়ে নেওয়া হতো। এমনকী, পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের নামে ভুয়ো উত্তরপত্র জমা পড়ত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ বা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোর্সের সময়সীমা শেষ হলে পড়ুয়াদের এসএমএস পাঠিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হতে বলা হতো। সেখান থেকে হাতে হাতে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হতো। কিছু কিছু কলেজ আবার কোনও একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেটিকে ‘পরীক্ষা হল’ বলে দেখাত। তারপর আগে থেকে ভরিয়ে রাখা উত্তরপত্র পর্ষদ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিত। এই বিএড কলেজগুলি মূলত দক্ষিণবঙ্গের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ডিএলএড কলেজগুলি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আওতাধীন। এখানেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে পর্ষদ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভূমিকা।
আরও পড়ুন হৈমন্তীর কাছে আছে ১০০০ কোটি, দাবি ED’র
নিয়ম অনুযায়ী, এরকম কোনও কলেজ অনুমোদনের জন্য আবেদন করলে সরেজমিনে সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় বা পর্ষদের কর্তাদের। তাদের প্রতিনিধি দল পরিকাঠামো সহ নানা বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে তবেই এনওসি মেলে। এক্ষেত্রে কোনওটাই হয়নি। ED’র আধিকারিকেরা আরও জেনেছেন যে, নতুন কলেজের অনুমোদনের জন্য আবেদনের কপি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে জমা পড়ত। তাঁর নির্দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় বা পর্ষদের কর্তারা সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীকে NOC দিয়ে দিতেন।