নিজস্ব প্রতিনিধি: এক সপ্তাহ আগেও সব কিছুই ছিল। আজ সব শেষ। পড়ে আছে শুধুই কাদামাটির দলা। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বসবাসের অযোগ্য ৭-৮টি ভাঙা বাড়ি। তাও ভেঙে ফেলতে হবে নিজেদের হাতেই। যাদের বাড়ি গিয়েছে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে তাঁরা নিজেরাই এখন বুঝতে পারছেন না তাঁদের ঠিক কোথায় ঘরখানি ছিল। অজয়ের জল সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। ভেসে গিয়েছে ঘরবাড়ি, সেখানে থাকা সব সামগ্রী। ভেসে গিয়েছে গাছগাছালি মায় আস্ত বাঁশ গাছের ঝাড়, কুয়োর পাড়। ভেঙে পড়েছে হাজার মানুষের বসবাসযোগ্য কয়েকশো মাটির বাড়ি। সব এখন কাদামাটির ধ্বংসস্তূপ। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও ৪-৫ ফুটের গর্ত হয়ে গিয়েছে। বোঝা মুশকিল কোনটা রাস্তা ছিল আর কোনটা ডোবা। সব গিয়েছে হারিয়ে। অজয়ের জল ভেঙে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে গ্রামের দুর্গাদালানও। ভেসে গিয়েছে প্রতিমাও। তাই বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার নানুর ব্লকের অজয়ের পাড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরপুর গ্রাম জুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন, ‘শ্মশানে কি মায়ের পুজো হয়। মা ভেসে চলে গিয়ে ভালই করেছেন। এবার আর পুজো হবে না।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে বাঁধ ভেঙেছিল অজয়ের। সেই বানভাসি জলে প্লাবিত হয়েছিল নানুরের বিস্তীর্ন এলাকা। কিন্তু সুন্দরপুরের মতো এত খারাপ অবস্থা কোথাও হয়নি। খ্যাপা অজয়ের জল সুন্দরপুরের হাজার মানুষের বসতিকে কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। এখন সুন্দরপুরে পা রাখলে বোঝা মুশকিল সেখানে হাজার মানুষের বসতি ছিল কোনওকালে। কেননা জল সরতেই এখন দেখা যাচ্ছে, সব মাটির বাড়ি তো বটেই গ্রামে থাকা একতলা পাকা বাড়িও ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে গোটা গ্রামকেই কাদা আর বালির স্তূপ বানিয়ে চলে গিয়েছে অজয়ের বাঁধ ভাঙা জল। গ্রামে ৭-৮টি পাকা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও সেই সব বাড়ির ভিতের মাটি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। যে কোনওদিন সেই সব বাড়ি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। তাই ওইসব বাড়ির বাসিন্দাদের নিজেদের উদ্যোগেই এখন ওই সব বাড়ি ভেঙে ফেলার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। একদিন যারা তিলে তিলে পাকা বাড়ি গড়ে তুলেছিলেন, একতলা বাড়িকে দুইতলা বা তিনতলা করেছিলেন সেই সব বাড়িকে এখন নিজেদের গ্যাঁটের টাকা খরচ করেই ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। বাস্তবিক অর্থেই সুন্দরপুর এখন ভয়ংকর ভাবেই অসুন্দর এক শ্মশান হয়ে উঠেছে।
গ্রামের বাসিন্দাদের প্রায় সবাই একবাক্যে জানিয়েছেন, এর আগেও তাঁরা বন্যার মুখে পড়েছেন। কিন্তু তা ছিল নদীর বাড়তি জলের উপচে পরা অবস্থা। তাতে স্রোত থাকলেও সব কিছু ভেঙে ধুয়েমুছে সাফ করার ক্ষমতা থাকতো না। ২-৩ দিনেই সেই জল সরে যেত। গ্রাম তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে কোনও সমস্যার মুখেই পড়তো না। কিন্তু এবারে কার্যত টানা ২ দিন গোটা গ্রাম একতলারও বেশি উচ্চতার জলের তীব্র স্রোতের নীচে ডুবে ছিল। সেই ভয়ংকর স্রোতই গোটা সুন্দরপুরকে বিলুপ্ত সভ্যতায় পরিণত করেছে। সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে গ্রামের হাজারখানেক বাসিন্দাকে। গ্রামে চলছিল দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। কিন্তু এখন গ্রামের লোকেরাই বলছেন, ‘আর কী হবে পুজো করে। গোটা গ্রামই তো শেষ হয়ে গিয়েছে। আর এই গ্রাম নতুন করে গড়ে উঠবে কিনা সন্দেহ। গ্রামের দুর্গাদালান ভেঙে ভেসে সাফ হয়ে গিয়েছে। প্রতিমার কাঠামোও ভেসে কোথাও বেড়িয়ে গিয়েছে। ভালই হয়েছে মা নিজেই চলে গিয়েছেন। সুন্দরপুর আজ শ্মশান। শ্মশানে কি মায়ের পুজো হয়!’