নিজস্ব প্রতিনিধি: মধ্য কলকাতার(Central Kolkata) কলুটোলা(Kolutola)। সেখানেই বদনচন্দ্র রায়ের বাড়িতে সপরিবারে ৪ দিনের জন্য আসেন দেবী দুর্গা। এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল অযোধ্যার রায়নগর। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করার পরে তাঁরা প্রথমে ইডেন হসপিটাল রোডের কাছে বাড়ি বানিয়েছিলেন, কিন্তু সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তৈরির সময় তাঁদের সে বাড়ি ভাঙা পড়ে। পরবর্তীকালে ১৮৫৭ সালে বর্তমান বাড়িটি নির্মিত হয়। নির্মান করে প্রখ্যাত ম্যাকিনটোস ও বার্ন কোম্পানি। আদিতে পোস্তা-রাজ সুখময় রায়ের জ্ঞাতিবংশীয় এই সুবর্ণবণিক রায় পরিবারের পদবি ছিল পাল। কোনও এক উত্তর পুরুষ ইংরেজ আমলে ‘রায়’ উপাধি লাভ করেন। বদনচাঁদ রায় ছিলেন এই পরিবারের অন্যতম কৃতী পুরুষ। তিনি ১৮৫৮ গোপালচন্দ্র লেনের বাড়িতে দুর্গাপুজো(Badan Chandra Roy’s Durga Puja) আরম্ভ করেন। সেই পুজোয় যাতে কোনও ব্যাঘাত যাতে কোনওদিন না ঘটে তার জন্য পিতা মথুরামোহনের সম্পত্তি এবং তার সঙ্গে পেশায় বেনিয়ান-ব্যবসায়ী বদনচন্দ্রের স্বোপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৮৫৮-তেই ‘বদনচন্দ্র রায় এস্টেট’ নামে ট্রাস্ট গঠন করেন। সেই আয় থেকে আজও এ বাড়ির পুজো সম্পাদিত হয়। কলকাতা পুরনিগমের(KMC) ‘ঐতিহবাহী বাড়ির’(Heritage House) তালিকায় রয়েছে ভদ্রাসন-সহ এই বাড়ির ঠাকুরদালান।
বদনচন্দ্র বাড়ির দুর্গাপুজো বিখ্যাত তার ঠাকুরদালানের জন্য আর দেবী দুর্গার সাজের জন্য। কেননা এই বাড়ির ঠাকুরদালানে রয়েছে ঢালাই লোহার অলঙ্কারযুক্ত আলোকস্তম্ভ। ঝাড়বাতির পাশাপাশি অতীতে সমগ্র বাড়িতে জ্বলত গ্যাসের আলো। এখন আবার সেখানে রঙিন বাল্ব জ্বলে। এই বাড়িতে পা রাখলেই চোখে পড়বে পাঁচ খিলানের দু’দালান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান। সামনে বড় উঠোনে ঢালাই লোহার অলঙ্কৃত রেলিং দিয়ে ঘেরা নাটমন্দির। বদনচন্দ্র রায় ঠিক যেমন বাঙালি ছাঁচে দেবী প্রতিমা তৈরি করিয়েছিলেন, আজও তার অন্যথা হয় না। রায় পরিবারের ঠাকুরদালানেই এই প্রতিমা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হয়। কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন। প্রতিপদাদিকল্পে পুজো, অর্থাৎ মহালয়ার পরের দিন থেকে আরম্ভ হয় বোধন। সাবেকি একচালা ডাকের সাজের ১০ ফুট উচ্চতার বাংলা শৈলীর মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা সেদিন থেকেই সকলের চোখ টানে। দেবী ডাকের সাজে সজ্জিতা হলেও গায়ে থাকে সোনার বহুমূল্যের সব গয়না আর হাতে থাকে রূপোর অস্ত্র।
এখানে অষ্টমী ও সন্ধিপুজোয় বাড়ির মহিলারা ধুনো পোড়ান। অষ্টমী পুজোর আরতির পর ও সন্ধিপুজোয় দেড়-শতাধিক মহিলা একসঙ্গে বসে পরিবারের মঙ্গল কামনায় সেই ধুনো পোড়ান। এই পরিবার বৈষ্ণব। তাই পশুবলির হয় না। হয় ফল বলি। মাকে চিনি ও চালের নৈবেদ্যর পাশাপাশি বিভিন্ন ফল, মিষ্টি, লুচি, কচুরি নিবেদন করা হয়। পঞ্চমীর দিন থেকেই বাড়িতে ভিয়েন বসে ও সেখানেই গজা, খাজা, পোড়াকি প্রস্তুত করা হয়। সন্ধিপুজোয় ১০৮টি প্রদীপ ও পদ্মের পাশাপাশি নিবেদন করা হয় ১০৮টি সশিস ডাবও। নলিনচন্দ্র দাসের দোকান থেকে কেনা হয় বিশেষ সন্দেশ। এ বাড়িতে প্রতিদিনই ঠাকুরের ভোগ হিসেবে খাস্তা কচুরি, মিষ্টি, ফল ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। অষ্টমীর সন্ধি পুজোয় রায় পরিবারে চার মণ চাল, এক মণ চিনি, ১০৮টি ডাব এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক দেওয়া হয়।
এই পুজোর আরও একটি বিশেষ আকর্ষণ বিসর্জন পর্ব। অতীত রীতি অনুযায়ী এ বাড়িতে প্রতিমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। এখনও দেবী দুর্গাকে পালকি করে নিয়ে যাওয়া হয় বিসর্জনে। এ বাড়িতে পুজো উপলক্ষে আগে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক-সহ বহু বিশিষ্ট শিল্পীর গানে মুখরিত হয়ে উঠত পুজো প্রাঙ্গণ। ১৯৩৮ সালের এক নথি থেকে জানা যায় সেই সময়ে দুর্গাপুজোর পাঁচ দিন ধরে সকাল-বিকেল দু’বেলা এই বাড়িতে ৫০০ থেকে ১০০০ জনের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকত। সেই প্রথা মেনে আজও রায় পরিবার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বহু সাধারণ মানুষের জন্য ভোগের আয়োজন করে থাকেন। দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পরে বাড়ির সকল জ্ঞাতি এবং আত্মীয়-স্বজনেরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন।