এই মুহূর্তে




এই মহাশক্তিপীঠে পতিত হয়েছিল সতীর স্তন, জেনে নিন তারাতারিণীর অজানা কাহিনি




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : সমগ্র ভারত জুড়েই রয়েছে নানা তীর্থ স্থান। দেবাদিদেবের জ্যোতির্লিঙ্গ থেকে শুরু করে শ্রী হরির নানা ধাম এবং আদ্যাশক্তি ভগবতী সতীর পীঠস্থান – এই সবেরই মেল বন্ধন ঘটেছে পূণ্যভূমি ভারতে। জানা যায়, ওড়িশা রাজ্যের গঞ্জাম জেলার ব্রহ্মপুর বা বেরহামপুর শহরের কাছে রুশিকুল্যা নদীর তীরে অবস্থিত তারাতারিণী মন্দির হিন্দু ধর্মের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান ও শক্তিপীঠ। এই শক্তিপীঠে দেবী সতীর স্তন পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয় এবং সেই কারণেই এই স্থানকে “স্তন মন্দির” নামেও অভিহিত করা হয়। এই মন্দিরে যমজ দেবী তারা ও তারিণী-কে আরাধনা করা হয়, যারা আদি শক্তির রূপে পরিচিত। এটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থানই নয়, বরং ইতিহাস, পুরাণ, লোকবিশ্বাস এবং স্থাপত্যের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ।

অবস্থান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

তারাতারিণী মন্দিরটি ব্রহ্মপুর শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে, কুমারী পাহাড় নামক এক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। পাহাড়টির পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে রুশিকুল্যা নদী, যাকে স্থানীয়ভাবে “ঋষিকল্যাণী” বলা হয় এবং এটি গঙ্গার বড় বোন হিসেবে পরিচিত। মন্দিরটি ঘিরে থাকা প্রকৃতি, সবুজ গাছপালা, বনজ পরিবেশ ও উচ্চতা—সব মিলিয়ে এটি এক অপূর্ব শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় আবহ তৈরি করে।

 দেবী তারা ও তারিণী

এই মন্দিরে পূজিত হন তারা ও তারিণী, যমজ রূপে আদিশক্তির প্রকাশ। পুরাণ অনুযায়ী, তারা ও তারিণী হচ্ছেন দেবী সতীর স্তনযুগলের প্রতীক। এই দেবদ্বয়ীকে মূলত মাতৃরূপে পূজা করা হয় এবং তাঁরা সংহার ও সৃষ্টির শক্তির একত্র রূপ।

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দক্ষযজ্ঞে সতীর আত্মাহুতির পর শিব যখন সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে সমগ্র পৃথিবী ঘুরছিলেন, তখন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সেই দেহ খণ্ড খণ্ড করেন। দেবী সতীর দেহের স্তন দুটি এই স্থানে পড়ে বলে মনে করা হয় এবং সেই থেকেই এটি একটি শক্তিপীঠ হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে।

 স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী

তারাতারিণী মন্দিরটি রেখা শৈলীতে নির্মিত, যা ওড়িশার মন্দির স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। মন্দিরের বাইরের দেয়ালে সাদা ও কমলা পাথরের প্রলেপ ও অলঙ্করণ রয়েছে। এতে পর্যটকদের জন্য ছায়া ও প্রশান্তির একটি পরিসর তৈরি করে।

মন্দির চূড়ার উচ্চতা ও গঠন কলিঙ্গ রাজবংশের নির্মাণশৈলীর প্রভাব বহন করে। চূড়ায় রয়েছে সোনালি কলস এবং ধ্বজ, যা উপাসকদের মধ্যে ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীক।

 উপসর্গ ও সিঁড়িপথ

মন্দিরে পৌঁছতে হলে ভক্তদের ৯৯৯টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। যদিও এখন রোপওয়ে এবং গাড়ির রাস্তা থাকায় প্রবেশ আরও সহজ হয়েছে, তবুও অনেক ভক্ত পুণ্য অর্জনের জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পছন্দ করেন। সিঁড়ির শুরুতে একটি বিশাল প্রবেশদ্বার রয়েছে, যা মন্দিরের মহিমা ও গুরুত্বকে চিহ্নিত করে।

 পুরাণ ও কিংবদন্তি

মন্দিরের একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, এক বাসু প্রহরাজ নামক ব্রাহ্মণ তাঁর দুই কন্যা তারা ও তারিণীকে হারিয়ে গভীর দুঃখে ভুগছিলেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, তাঁর কন্যারা আসলে আদিশক্তির রূপ এবং মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দেন। এরপর তিনি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেন এবং এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

 আনুষ্ঠানিকতা ও লোকসংস্কৃতি

তারাতারিণী মন্দিরে চৈত্র মাসে প্রতি মঙ্গলবার এক বিশাল মেলা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত তাঁদের ইচ্ছাপূরণের আশায় এই সময় মন্দিরে ভিড় করেন। বিশেষ করে, নবজাতকের প্রথম চুল কাটার রীতি (মুন্ডন) এখানে পালন করা হয়—যা স্থানীয় সংস্কৃতিতে দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি।

এছাড়া দেবীকে সোনার গহনা, রত্ন ও মূল্যবান পাথর দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়। দক্ষিণ ওড়িশার বহু পরিবার এই দেবীকে তাঁদের গৃহদেবী হিসেবে মানেন এবং তাঁদের প্রতীক মূর্তি গৃহে স্থাপন করেন।

চার আদি শক্তিপীঠের একটি

তারাতারিনী মন্দিরকে ভারতের চারটি আদি শক্তিপীঠের একটি বলে মনে করা হয়-

  • কামাখ্যা (যোনি পতিত স্থান – অসম)
  • কালীঘাট (ডান পায়ের আঙুল পতিত স্থান – কলকাতা)
  • বিমলা (পুরী) – যেখানে পা পড়েছিল
  • তারাতারিনী – যেখানে স্তন পড়েছিল

এই চারটি পীঠ হিন্দুধর্মে শক্তি উপাসনার মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়।

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, তারাতারিণী মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়, এটি পুরাণ, ইতিহাস, ভক্তি এবং স্থাপত্যের এক অনন্য মিশ্রণ। আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পাশাপাশি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্মিলনে গড়ে ওঠা এই স্থান শুধুমাত্র ভক্তদের জন্য নয়, পর্যটকদের কাছেও এক বিশেষ আকর্ষণ।

যাঁরা ভক্তিভরে শক্তি আরাধনা করেন, তাঁদের জীবনে অন্তত একবার এই পবিত্র ভূমিতে এসে দেবী তারা ও তারিণীর দর্শন নেওয়া উচিত — কারণ এখানেই ঈশ্বরীর এক অনন্ত রূপ বাস করে।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

ভারতে একাধিক হামলার মাস্টারমাইন্ড, পাকিস্তানে নিহত লস্কর সন্ত্রাসী

প্রথমে দিয়েছিল ঋণ, এখন ১১টি শর্ত চাপিয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করল আইএমএফ

মৃত্যু যেন ওঁত পেতেছিল! খাটিয়ায় ঘুমন্ত যুবকের মাথায় কাল কেউটের ‘ছোবল’

জ্যোতি মালহোত্রা মামলায় নয়া মোড়, এবার আইবি’র নজরে জগন্নাথধামের ইউটিউবার

শিবতাণ্ডব স্তোত্রে ভরসা রেখে জঙ্গি ধ্বংস করেছিল ভারতীয় সেনা, অপারেশন সিঁদুরের সেই ভিডিও প্রকাশ্যে

পহেলগাঁও হামলাতেও কি হাত ছিল জ্যোতির, ভিডিও সামনে আসতেই হল পর্দাফাঁস

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ