নিজস্ব প্রতিনিধি: প্রাচীন কাল থেকেই অবিভক্ত বাংলাদেশে ডাকাতির সঙ্গে কালীপুজো ও তন্ত্রসাধনার এক সুনিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। সেই আদিকাল থেকেই ডাকাতদল ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে কালীপুজো করতেন। তাঁদের পুজোর ধরণ ছিল যেমন আলাদা, তেমনই রীতিনীতি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। যা আজও কিছুটা ইতিহাসের পাতায় এবং অধিকাংশই জনশ্রুতিতে রয়ে গিয়েছে। এমনকি বাংলার বুকে বহু পীঠস্থান নির্মানের নেপথ্যেও রয়েছেন এককালের দুর্ধর্ষ কোনও ডাকাত। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায় এককালে বাংলার কালীপুজোর সূচনাও ঘটেছিল এই ডাকাতদের হাত ধরে। যা ডাকাত কালী মন্দির নামেই পরিচিত। আমরা সেরকমই কয়েকটি ডাকাত কালী মন্দিরের অজানা ইতিহাস এবং পুজোর রীতি জানাবো।
রঘু ডাকাতের কালীপুজো
আজও গভীর জঙ্গলে রটন্তী কালী মন্দিরে হয় রঘু ডাকাতের কালীপুজো হয়। এককালে হতো নরবলি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে অনেক রীতিনীতি। রঘু ডাকাতের কালীপুজো ঘিরে অসংখ্য রূপকথার জন্ম। জনশ্রুতি কেতুগ্রামের অট্টহাসে রঘু ডাকাতের থানে সব রূপকথাই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে কালীপুজোর রাতে। সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল এখানে, তাই এই সতীপীঠের নাম অট্টহাস। প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে এই অট্টহাসের জঙ্গলে ডেরা বাঁধেন কুখ্যাত রঘু ডাকাত।
এখানে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডীর আসন। জানা যায়, এই পঞ্চমুণ্ডীর আসনে সাধণা করেছিলেন স্বয়ং বামাখ্যাপাও। রীতিমতো চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করতে যেতেন রঘু ডাকাত। বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ —এই তিন জেলায় ডাকাতি করতেন। আর ঈশাণী নদীর ধারে প্রায় ৩০ একর জমিতে গড়ে তোলেন অট্টহাস কালী মন্দির। এখানকার কালী রটন্তী কালী নামে পরিচিত। কালীমূর্তি পাথরের। এই মন্দিরে পুজো দিয়েই তিনি যেতেন ডাকাতি করতে। সেই থেকেই এই মন্দির রঘু ডাকাতের কালী বলে পরিচিত। তবে রঘু ডাকাতের সঙ্গে আরও কয়েকটি কালী মন্দিরের গল্প জড়িত।
ত্রিবেণীর ডাকাত কালী ও রঘু ডাকাত
রঘু ডাকাতের স্মৃতি বিজড়িত ত্রিবেণীর বাসুদেবপুরের ডাকাত কালী মন্দিরে আজও পুজো হয়। ত্রিবেণী ঘাটের এক কিলোমিটারের মধ্যে দুটি প্রধান রাস্তার সংযোগস্থলের পাশেই জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রয়েছে এই ডাকাত কালীর মন্দির। যে সাতটি গ্রাম নিয়ে সপ্তগ্রামের সৃষ্টি হয়েছিল তার অন্যতম বাসুদেবপুর। জনশ্রুতি এককালের দুই কুখ্যাত বা বিখ্য়াত যাই বলুন না কেন ছিলেন রঘু ও বুধো ডাকাত। কেতুগ্রামের অট্টহাস এলাকায় রঘু ডাকাতের থান রয়েছে। ত্রিবেণীর পূর্ব পাড়েও তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। এই দুই ডাকাতের আরাধ্যা দক্ষিণা কালী মন্দিরটি আজ তাঁদের স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। গম্বুজাকার, এক চূড়াবিশিষ্ট, এবং সামনে বিশাল চাতাল। মন্দিরের পিছনে রয়েছে একটি পুকুর যেখানে নাকি ডাকাতরা স্নান সেরে পুজো দিত বলে শোনা যায়। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে এই এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং জনসমাগমহীন। সেসময় ডাকাতরা এই মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় নরবলি দিতেন বলে শোনা যায়। তবে এখন ছাগবলি হয় সেই রীতি বজায় রেখে।
শোনা যায় একবার নাকি কালী উপাসক সাধক রামপ্রসাদ এই রঘু ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলেন। রঘু ডাকাতের দলবল রামপ্রসাদকে নরবলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় রামপ্রসাদ পড়লেন ঘোরতর বিপদে। অবশেষে একসময় জীবনের শেষ ইচ্ছা স্বরূপ তিনি রঘু ডাকাতের কাছে প্রার্থনা করলেন একটি ইচ্ছা। হাড়িকাঠে যাওয়ার আগে রঘু ডাকাতের কাছে মা কালীকে গান শোনানোর আর্জি জানালেন তিনি। সেটা মঞ্জুর হলে শ্যামা সঙ্গীত ধরলেন সাধক রামপ্রসাদ। এমন সময় হঠাৎই রঘু ডাকাতের চোখের সামনে হাড়িকাঠে ভেসে ওঠে রামপ্রসাদের বদলে মা কালীর মুখ। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যান কুখ্যাত ডাকাত রঘু। তৎক্ষণাৎ বলি বন্ধ করে রামপ্রসাদের সেবার ব্যবস্থা করেন তিনি এবং পরদিন রামপ্রসাদকে বাড়ি পৌঁছে দেন।