কৌশিক দে সরকার: তিনি পাল্টিবাজ মাস্টার এটা গোটা ভারত জানে। যখন তখন যে কোনও জোটে পা রাখতে বা কোনও জোট থেকে বেড়িয়ে যেতে যে তিনি সিদ্ধহস্থ সেটাও সবাই জানে। তবুও মনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুপ্ত আশা নিয়েই তিনি নেমে পড়েছিলেন বিজেপি বিরোধী জোট গড়ে তোলার লক্ষ্যে। সেই জোট গড়েও ওঠে। কিন্তু সেই জোটের কোনও শরিক দলই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের মুখ হিসাবে তুলে ধরতে চায়নি। বরঞ্চ সেই পদের জন্য তাঁর মুখ তুলে ধরা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ ও আপত্তি সবার আগে জানিয়েছেন যিনি তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee)। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো তাঁর আপত্তিতে সুর মেলায় জোটের বাকি শরিকগুলিও। তাই তাঁর মানে নীতীশ কুমারের(Nitish Kumar) আর INDIA জোটের মুখ হয়ে ওঠা হয়নি। সেই কারণেই এদিন তাঁর INDIA জোট ত্যাগ এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন NDA জোটে প্রত্যাবর্তন। সেই সঙ্গে বিহারের রাজ্যপাটেও বদল। তবে নীতীশ প্রমাণ করে দিলেন তাঁকে নিয়ে মমতার আশঙ্কা শুধু সঠিক তাই নয়, মমতার হাতেই সব থেকে বেশি নিরাপদ থাকবে দেশে তৈরি হওয়া বিরোধী জোট INDIA।
২০২২ সালের অগস্ট মাসে NDA ছেড়েছিলেন নীতীশ। বিহারে সরকার চালাতে হাত ধরেছিলেন কংগ্রেস, আরজেডির। গড়ে উঠেছিল মহাগঠবন্ধন। তার কয়েক মাস বাদে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে নীতীশ জানিয়েছিলেন, ‘NDA-তে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না! মৃত্যুবরণ করব, তবু ওদের সঙ্গে জোট করব না।’ কিন্তু এদিন তিনি ফিরলেন সেই NDA-তেই। নীতীশকে যারা দেখেছেন, চিনেছেন, জানেন, তাঁরা এটা খুব ভালভাবেই জানেন, এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা আর অবশিষ্ট নেই। পাল্টি খেতে তিনি মহাওস্তাদ। তাঁকে বিশ্বাস করা আর সাপের গালে চুমু খাওয়া দুটোও সমান। তাঁকে কোনও জোটের মাথায় বসানো বা মুখ হিসাবে তুলে ধরা কার্যত রাজনৈতিক ভাবে আত্মহত্যার সামিল। আর সেই কারণেই মমতা চাননি নীতীশকে জোটের মুখ হিসাবে তুলে ধরা হোক। কেননা তিনি INDIA জোটের মুখ হয়েও যে কোনও দিন পাল্টি খেয়ে বিজেপির হাত ধরে নেবেন। বাস্তবেও সেটাই হয়েছে। নীতীশ কার্যত প্রমাণ করে দিলেন মমতাই ঠিক।
নীতীশের INDIA জোট ত্যাগ কী কোনও প্রভাব ফেলবে? সম্ভবত নয়। কেননা ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নীতীশ বিজেপির সঙ্গেই জোট গড়ে ভোটে লড়াই করেছিলেন। তারপরেও তাঁর দলের আসন কমেছিল ২৮টি। বিজেপির আসন বেড়েছিল ২১টি। সেই জায়গায় কংগ্রেস আর রাষ্ট্রীয় জনতা দলের আসন কমেছিল মাত্র ১৪টি। সেই শূন্যস্থান আবার পূরণ করে দিয়েছিল সিপিআই(এমএল) যারা ৯টি বাড়তি আসন পেয়েছিল। আসন পেয়েছিল সিপিআই ও সিপিআই(এম)-ও। এই ৫টি দলই কিন্তু এখনও INDIA জোটের শরিক। নীতীশ তাঁদের হাত ছেড়েছেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের জোট ভেঙে দিতে পারেননি। এই ৫টা দলের মোট প্রাপ্ত ভোট শতাংশের হিসাবে ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। নীতীশ এখন NDA-তে ফিরে যাওয়া সেটা কিন্তু এই ভোট শতাংশে কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। বরঞ্চ বিজেপির ভোট কমতে পারে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। যার জেরে বাড়তি ভোট পেয়ে যেতে পারে INDIA জোট। আর তার জেরে বিহারের ৪০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ২০টি কেন্দ্রে লড়াই করে জেতার জায়গায় থাকবে এই জোট। ভুললে চলবে না উনিশের লোকসভা ভোটে বিহার থেকে বিজেপি বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র কংগ্রেস ১টি আসন পেয়েছিল। শূন্য ছিল লালুর দলের ঝুলি। সেই ছবি কিন্তু ২৪’র ভোটে(General Election 2024) আর দেখা যাবে না। আর তাই নীতীশ বিজেপির হাত ধরলেও তাতে INDIA জোটের কোনও ক্ষতিসাধন ঘটবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মমতার হাতেই কেন নিরাপদ থাকবে INDIA? কারণ মমতাই এখন দেশের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য মুখ। তাঁর সঙ্গে মসৃণ সম্পর্ক বাম ও কংগ্রেস বাদে সব জোট শরিকদের সঙ্গেই। তাঁরা তাঁর কথাকে ও পরামর্শকে মান্যতাও দেয়। মমতা পরামর্শ মেনেই নীতীশকে INDIA জোটের মুখ করা হয়নি। তাই নীতীশ জোট ছাড়লেও তাতে ক্ষতি কিছু হবে না। কিন্তু মমতার পরামর্শ না মানলে আজ এই জোটকে অনেক বড় বিড়াম্বনায় পড়তে হতো। মমতাই কার্যত এই জোটকে বাঁচিয়ে দিলেন। তাঁর জনসংযোগের ক্ষমতা জোটের সব নেতানেত্রীদের থেকেও অনেক বেশি। মানুষকে কাছে টানতে পারেন তিনি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন তিনি। সমাজের সব বর্ণের সব ধর্মের মানুষের মধ্যে রয়েছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। বিজেপি সর্বশক্তি দিয়েও তাঁকে হারাতে পারেনি। বাংলা দখল করতে পারেনি। তাঁর থেকে বড় বিশ্বাসযোগ্য মুখ এখন আর কেউ বা আছে INDIA জোটে। তাই INDIA নিরাপদ মমতার হাতেই।