নিজস্ব প্রতিনিধি: মাথার উপর কিশোরী চাঁদ, সঙ্গে মাদলের বোল আর বাতাসে মহুয়ার ঝিম। সবমিলিয়ে ঝাড়গ্রামের টান উপেক্ষা করার নয়। জঙ্গলমহলের এই জেলাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রকৃতির অপার দান। ইচ্ছে হলে কোনও গ্রামের হোম স্টে-র সুযোগ নিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের সঙ্গে আদিবাসী লোকনৃত্য কিংবা নদীর চরে রণপা নাচ দেখার সুযোগ পাবেন। আবার বেলপাহাড়ির গাডরাসিনি পাহাড়ে ট্রেকিং অথবা সবুজ বনানীর ক্যানভাসে দুই একটা দিন আরামে কাটিয়ে দেওয়ার সুযোগ। সবমিলিয়ে এই করোনাকালে ঝাড়গ্রাম আপনাকে স্বাগত জানাতে তৈরি। তার প্রমান, ইতিমধ্যেই ঝাড়গ্রামের প্রায় ৭৫ শতাংশ রিসর্টে পুজোর বুকিং সারা হয়ে গিয়েছে।
তবে পর্যটকদের থাকার জন্য ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় গেস্ট হাউস, হোম স্টে আর সরকারি ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি রিসোর্ট তো রয়েছেই। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে পর্যটকদের জন্য ছোট ছোট রিসর্ট চালু হয়েছে। যার তথ্য তালাশ আপনি পেয়ে যাবেন ঝাড়গ্রামের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। পুজোয় ঝাড়গ্রাম কেন? আসলে বাড়ির বাইরে গিয়েও পুজোর মজা আর শান্ত নিরিবিলি একেকটি পর্যটন কেন্দ্রে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া দুটোই সম্ভব এখানে। বরং বলতে পারেন কী নেই এখানে? বেলপাহাড়ির ঘাঘরা, ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ি, খাঁদারানি, কাঁকড়াঝোড় গাড়রাসিনি, লাল জল গুহা, চিল্কিগড়, শালবনী, হাতিবাড়ি এরকম অনেক অসাধারণ পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলায়।
ঝাড়গ্রামে জনপ্রিয় হচ্ছে সপ্তাহান্তের প্যাকেজ ট্যুর। দুই বা তিনদিনের প্যাকেজ ট্যুরে অনেকেই চলে আসেন জঙ্গলমহলের এই প্রান্তে। জনপ্রতি সুলভ খরচে বেড়ানোর জন্য ভিড়ও বাড়ছে এই এলাকায়। এক ট্যুর অপারেটরের কথায়, জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি শান্ত হওয়ায় গত কয়েকবছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পর্যটক বেড়াতে আসছিলেন। উইক এন্ডে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রিক অবসর কাটানোর প্রবণতা বাড়ছিল। তবে করোনার আক্রমণে জোরদার ধাক্কা খেয়েছিল পর্যটন। কিন্তু এই পুজোর মরশুমে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্পূর্ণ সুযোগ এসেছে তাঁদের সামনে।
ঝাড়গ্রাম শহরেই পাবেন রাজবাড়ি। প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো এই প্রাসাদ দেখতে দেখতে আপনি কখন যে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়বেন বুঝতেই পারবেন না। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে এখানকার রাজা সর্বেশ্বর সিং এই রাজবংশের প্রতিষ্টা করেছিলেন। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির গৌরবময় ইতিহাস নান্দনিকতা এবং সোন্দর্য্য চিরকাল পর্যটকদের হৃদয়কে আলোড়িত করেছে। উল্লেখ্য এখানে সন্ন্যাসী রাজা, টিনটোরেটোর যীশু, দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন প্রভৃতি বিখ্যাত বাংলা চলচিত্রের শুটিং হয়েছে।
কনকদুর্গা মন্দির ঝাড়গ্রামের প্রধান আকর্ষণ বলা যায়। প্রায় ৫০০ বছরেরে বেশি প্রাচীন এই মন্দির ঘিরে বহু জনশ্রুতি ও লোককথা ছড়িয়ে। ঝাড়গ্রাম তথা জঙ্গলমহলের অধিবাসীদের মধ্য়ে অত্যন্ত জাগ্রত মা কনকদুর্গা। এই মন্দির দর্শনে গেলে ঝাড়গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা এনে দেবে আপনাদের। শহর থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে এই মন্দিরটি ডুলুং নদীর তীরে, পাশেই ঘন জঙ্গল। মন্দিরটি রাজা গোপীনাথ নির্মাণ করেছিলেন, কথিত আছে তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েই দেবীর মূর্তি পান এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায় এককালে এখানে নরবলিও হত। আর যতক্ষণ না বলির রক্ত ডুলুং নদীতে পৌছাত ততক্ষন চলতো বলির অনুষ্ঠান। এখানেই আছে চিল্কিগড় রাজবাড়ি। চিল্কিগড়ের রাজা ধলরাজকে পরাজিত করে সূর্য বংশী রাজা জগৎদেব নিজেকে রাজা ধবলদেব হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরই বংশধরেরা এই রাজবাড়ি নির্মান করেছিলেন।
অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম শহরের পূর্বপ্রান্তে রয়েছে ডিয়ার পার্ক বা চিড়িয়াখানা। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য়ে এই চিড়িয়াখানা বর্তমান রাজ্য সরকারের উদ্য়োগে বেশ বড় হয়েছে। এখানে দেখতে পাবেন কৃষ্ণসার হরিণ, ময়ূর, ভাল্লুক, হায়না, বাঁদর , চিতা, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। এছাড়া আশেপাশেই আছে ঋষিকৃষ্ণপূরম ও সৎসঙ্গ আশ্রম। নয়াগ্রামের রাজা চন্দ্রকেতু নির্মান করিয়েছিলেন রামেশ্বর মন্দির। নির্মানকাল ১৬ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে। ঝাড়গ্রাম শহরের কাছেই ভগবান শিবের এই মন্দিরের আশেপাশের পরিবেশ অতি মনোরম। রামেশ্বর মন্দির যাওয়ার পথেই দেখে নিতে পারেন তপোবন। এখানে দেখবেন রাম, সীতা, হুনুমান ও লব-কুশের একটি সুন্দর মন্দির। ঘন জঙ্গলের মধ্য়েই তিরতিরে জলের একটি নদীর পাশে মন্দিরটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এছাড়াও আরও অনেক জায়গা আছে, যেগুলি সম্পর্কে আগামী পর্বে জানাবো আপনাদের।
কীভাবে যাবেন এবং কোথায় থাকবেন?
কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের ট্রেনপথে দূরত্ব ১৫৪ কিলোমিটার। ট্রেনে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। ঝাড়গ্রাম যাওয়ার সবচেয়ে ভালো ট্রেন ইস্পাত এক্সপ্রেস। ট্রেনটি হাওড়া থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে ঝাড়গ্রাম পৌঁছে দেয় সাড়ে আটটার মধ্য়ে। সড়কপথে দূরত্ব ১৭৮ কিমি, এই রুটে প্রচুর বাস যায় ঝাড়গ্রামে। নিজেদের গাড়িতেও পৌঁছে যেতে পারেন ঝাড়গ্রাম। সময় লাগবে কমবেশি ৪ ঘণ্টা। ঝাড়গ্রাম জেলার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট jhargram.gov.in থেকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় হোটেল, হোম স্টে বা রিসর্টের বুকিং করা যায়।