নিজস্ব প্রতিনিধি: কেন্দ্র রাজ্য সঙ্ঘাতের নয়া নিদর্শন আবারও গড়তে চলেছে বাংলার বুকে, দেশের বুকে। কেননা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছুতেই বাগে আনতে না পেরে শেষে গোটা দেশের আমলাকুলের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিতে চলেছে মোদি সরকার। আর তা কানে এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে নবান্ন থেকে হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটেও। কেননা মোদি সরকারে এই পদক্ষেপের দরুণ আমলাকুলের রাশ আর রাজ্যের হাতে ছিঁটেফোঁটাও যেমন থাকবে না তেমনি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোও ধাক্কা খাবে। কার্যত প্রশাসনের একটা বড় অংশই তখন কেন্দ্রমুখী ও এককেন্দ্রীক হয়ে উঠবে যা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি দেশের প্রায় সব আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতাদেরই তীব্র আপত্তি রয়েছে। যদিও তাতে মোদি সরকার আদৌ কর্ণপাত করবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
দেশের সংবিধান ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী কোনও আইএএস বা আইপিএস অফিসার যখন কোনও রাজ্যের কাজে যুক্ত হন তখন তিনি রাজ্যের আমলা বলেই চিহ্নিত হন। আর তিনি যদি কেন্দ্রের কাজে নিযুক্ত হন তাহলে তিনি কেন্দ্রের আমলা বলে চিহ্নিত হন। কে কেন্দ্রে যোগ দেবেন আর কে রাজ্যে সেটা আবার অনেকটাই নির্ভর করে তাঁদের আইএএস পরীক্ষার ফলাফল, ট্রেনিং চলাকালীন পরীক্ষার ফল মিশিয়ে তৈরি হওয়া র্যাংকের ভিত্তিতে। যদিও রাজ্যে নিযুক্ত আমলারা যেমন বিশেষ প্রয়োজনের কেন্দ্রে ডেপুটেশন হিসাবে কাজে যোগদান করতে পারেন তেমনি কেন্দ্রের আমলারাও রাজ্যে ডেপুটেশন ভিত্তিতে কাজ করতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজন হলে কেন্দ্র বা রাজ্য উভয়েই তাঁকে ফের নিজের ডেরায় ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু এই জায়গাতেই এবার পরিবর্তন আনতে চাইছে মোদি সরকার। তাঁরা আমলাকুলের ওপর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার কার্যত কেঁটেছেঁটে ফেলে দিতে চাইছে। তার জন্য ১৯৫৪ সালের আইএএস (ক্যাডার) আইন সংশোধন করার পথে পা বাড়িয়েছে মোদি সরকার।
সন্দেহ নেই আমলাকুলের রাশ নিজেদের হাতে একচ্ছত্র ভাবে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা মোদি সরকার শুরু করেছে তা যে শুধু রাজ্য ও কেন্দ্রের দ্বন্দ্বকে আরও বৃহত্তর আকার দেবে তাই নয়, বস্তুত দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও প্রচণ্ড ধাক্কা ধাক্কা দেবে বলে মনে করছেন সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ থেকে প্রাক্তন ও বর্তমান আমলারা। সেক্ষেত্রে গোটা বিষয়টি নিয়ে শুধু রাজনৈতিক মহলেই বড় বিবাদ দেখা দেবে তাই নয়, আদালতেও বড় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এমনকি সাউথ ব্লক সূত্রে জানা গিয়েছে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছুতেই বাগে আনতে না পেরে মোদি সরকার এই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এমনকি আলাপনকে যাতে বড় কোনও শাস্তি দেওয়া যায় সেই পদক্ষেপও করতে শুরু করে দিয়েছে মোদি প্রশাসন।
কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনের প্রশ্নে সাধারণ ভাবে রাজ্যের মতামত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আমলা মহলের অনেকে। তাঁদের যুক্তি, রাজ্যের সম্মতি বা ছাড়পত্র না-থাকলে কোনও আইএএস বা আইপিএস অফিসার কেন্দ্রের ডেপুটেশনে যোগ দিতে পারেন না। কিন্তু অনেকের বক্তব্য, কেন্দ্র ডেপুটেশনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বজায় রাখলে সার্ভিস রুলের ৬(১) ধারা অনুযায়ী রাজ্যের কিছু করার নেই। দেশের রাষ্ট্রপতির দ্বারা নিযুক্ত সর্বভারতীয় ক্যাডার অফিসারদের নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ বাধলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই মানতে হবে রাজ্যকে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, ‘বিবাদ’ এড়াতে ক্যাডার আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার বাধ্যতামূলক প্রয়োগের পথেই হাঁটতে চাইছে কেন্দ্র। এক বার আইএএস-দের ক্ষেত্রে সংশোধিত আইন চালু করা গেলে আগামী দিনে হয়তো আইপিএস অফিসারদের ক্ষেত্রেও তেমনই পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র।
কেন্দ্রের এই উদ্যোগে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকেই। এই পদক্ষেপের জেরে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ধাক্কা খাবে। অনেকেই মনে করছেন মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ ভুল। অনেক রাজ্যই এতে আপত্তি জানাবে। কেন্দ্র একতরফা ভাবে এই নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখলে রাজ্যের অফিসারেরা পুরোপুরি কেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। রাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে সেটা মোটেই সুখকর হবে না। ধাক্কা খাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।