নিজস্ব প্রতিনিধি: সবাই তাকিয়ে ছিলেন, এই সভার দিকে। কেননা অনেকেরই ধারনা ছিল এই সভা থেকেই জঙ্গলমহলের(Junglmahal) বুকে সাম্প্রতিকতম মাওবাদী(Maoists) কার্যকলাপ নিয়ে কোনও বার্তা দিতে পারেন তিনি। বার্তা তিনি অবশ্যই দিলেন। তবে তা এইসব উপদ্রবের পিছনে থাকা মাথাদের টেনে বের করে আনার লক্ষ্যে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ‘জঙ্গলমহলে মাওবাদী বলে কিছু নেই। তবে তাদের নামে হাতে লেখা পোস্টার সাঁটিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’ বুধবার দুপুরে ঝাড়গ্রামের(Jhargram) প্রশাসনিক বৈঠক থেকে এই বার্তাই দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee)। তবে একইসঙ্গে তিনি পুলিশ(Police)-প্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে মাওবাদীদের নাম করে জঙ্গলমহলের বুকে কেউ যেন দাঙ্গা বাঁধাতে না পারে তা লক্ষ্য রাখার জন্য।
মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ৪ দিনের জঙ্গলমহল সফর। গতকাল তিনি মেদিনীপুরে প্রশাসনিক বৈঠক সেরেছেন। এদিন মেদিনীপুর শহরের কলেজ মাঠে করেছেন দলীয় কর্মী সভাও। সেই সভা সেরেই মুখ্যমন্ত্রী চলে আসেন ঝাড়গ্রামে। যোগ দেন প্রশাসনিক বৈঠকে। একসময় এই ঝাড়গ্রামই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। মাওবাদীদের হাতে একের পর এক রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও সাধারন মানুষ খুন হয়েছিলেন বাম জমানার শেষদিকে ও তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে পরেই। তবে কিষাণজি মারা যাওয়ার পর থেকেই জঙ্গলমহল জুড়ে মাও কার্যকলাপে ভাটা পড়ে। অনেকেই অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। এলাকারও প্রভূত উন্নতিসাধন ঘটিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে জয় জোহর, কন্যাশ্রী থেকে ঐক্যশ্রী, সবুজসাথী থেকে খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী থেকে সবুজশ্রী’র মতো বহুবিধ রাজ্য সরকারি প্রকল্প মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পৌঁছে দিয়েছে জঙ্গলমহলের জনতার কাছে। তারপরেও বিগত কয়েক মাস ধরেই প্রায় ধারাবাহিক ভাবে জঙ্গলমহলের চার জেলা – পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের নানা প্রান্ত থেকে উদ্ধার হচ্ছিল একের পর এক পোস্টার। উদ্ধার হয়েছে ল্যান্ডমাইনও।
এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রী এদিনের সভা থেকে কী বার্তা দেন সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন সকলে। সেই সভা থেকেই এদিন জঙ্গলমহলের বুকে মাওবাদীদের উপস্থিতির সামান্যতম সম্ভাবনাকেও খারিজ করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সাফ জানান, ‘জঙ্গলমহলে মাওবাদী বলে কিছু নেই। তবে কিছু লোক মাওবাদীদের নাম করে অনেক কিছুই করে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে খবর এসেছে পুলিশ নাকি নির্দেশ দিয়েছে সন্ধ্যা ৬টার পরে বাইরে না বেরোতে! এটা কী ঠিক? কোন থানা থেকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে? পুলিশ থেকে কি এটা প্রচার করা হয়েছে, না কি এটা গুজব?’ এদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিন্হা। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান পুলিশ এবং প্রশাসনের তরফে এমন কিছুই বলা হয়নি। তা শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তার মানে এটা খুব গোপনে কেউ গুজব ছড়িয়েছে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করার জন্য। মাথায় রাখবেন, কেউ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। নেটমাধ্যমেও নজর রাখবেন। কারণ নেটমাধ্যমে যেমন ভাল লোক আছেন, তেমন অনেকে প্ররোচনাও দেয়। কেউ দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টাও করে। আবার মাওবাদীদের নাম করে মিথ্যা কথাও বলে। কেউ নিজে একটা হাতে পোস্টার লিখল। অনেকে আবার সেই পোস্টারের ছবি তুলে বিক্রি করল। আর এ দিকে লোকের মধ্যে আতঙ্ক রটিয়ে দিল। এটা কিন্তু মাওবাদীদের কাজ নয়। আমি চারদিকে খবর নিয়ে দেখেছি। যে বা যারা এর মধ্যে আছে, এটা তদন্ত করে খতিয়ে দেখা হবে।’
এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন একসময়ের দিন দুপুরে খুন হওয়ার এলাকা বেলপাহাড়ীর আইসি বিশ্বজিৎ বিশ্বাসকে। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার সীমানায় কী সমস্যা আছে? সিআরপিএফ ক্যাম্প আছে?’ বিশ্বজিৎ জানিয়ে দেন, তাঁর এলাকায় মোট সাতটি শিবির রয়েছে বিভিন্ন বাহিনীর। এর পর মমতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘সেখানে বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দেখছেন?’ বিশ্বজিৎ উত্তর দেন, ‘ওখানে পাঁচটি রাস্তার মাধ্যমে ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। নাকাতল্লাশিও চলছে। পাশাপাশি, সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে। সিআরপিএফও নাইট অ্যামবুশ এবং এরিয়া ডমিনেশনও জারি রেখেছে। পাশাপাশি, এলাকার লোকজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখি আমরা।’ এর পর পুলিশ সুপারকে আদিবাসী জনজাতির মহিলাদের নিয়ে ‘উইনার্স টিম’ তৈরি করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে রাজ্যের সীমানার নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন। এদিনের প্রশাসনিক সভা থেকে আত্মসমর্পণকারী এক মাওবাদী এবং মাওবাদী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত চার জনকে স্পেশাল হোমগার্ডে চাকরি নিয়োগপত্রও তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।