নিজস্ব প্রতিনিধি: দীর্ঘদিন ধরেই দাবি উঠেছিল এই জীবন্ত ইতিহাসকে যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করার। বার বার দাবি উঠছিল এই সংরক্ষণকে ঘিরে এলাকায় পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটানো হোক। অবশেষে সেই দাবি মেনে নিল রাজ্য হেরিটেজ কমিশন(State Heritage Commission)। হেরিটেজ তকমা পেল মুর্শিদাবাদের(Murshidabad) নিমতিতা রাজবাড়ি(Nimtita Rajbari)। আর সেটাও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের(Mamata Banerjee) উদ্যোগে। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়(Satyajit Roy) এই বাড়িতেই শুট করেছিলেন তাঁর ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘তিন কন্যা’, এই ৩টি সিনেমা। সেই সূত্রেই এই রাজবাড়িতে পা পড়েছিল ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, তুলসী লাহিড়ী, কালী সরকারের মতো স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। শুটিং চলাকালীন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায় ও পুত্র সন্দীপ রায়ও। এই রাজবাড়ির নির্মাতা গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী, তাও আজ থেকে প্রায় ১৭৫ বছর আগে। বাড়িটির আসল নাম নিমতিতা ভবন। কিন্তু দ্বারকানাথ চৌধুরী নিমতিতা এলাকায় জমিদারি পত্তন করছিলেন বলে সবাই এই বাড়িকে নিমতিতার রাজবাড়ি বলেই চেনে।
জানা গিয়েছে, দ্বারকানাথ চৌধুরী নিমতিতা এলাকায় জমিদারি পত্তন করার পরে এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের মঙ্গলের জন্য এই জমিদার বাড়িতেই প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। মহাসমারোহে দুর্গাপুজোর আয়োজনে মেতে উঠতেন গ্রামবাসীরা। চার দিন খুব ধুমধামের সঙ্গে দুর্গোৎসব পালিত হতো। চাঁদির ছাতা নিয়ে গঙ্গা থেকে ঘট ভরে আনা হতো। বাজত ১০০টি ঢাক। চলত নাচ, গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এক সময়ে নাটকের আঁতুড়ঘর এই রাজবাড়ির ঠাকুর দালান। ১৯৫৭ সালে প্রথম্বার সত্যজিৎ রায় ‘জলসাঘর’ সিনেমার শুটিং করতে এই বাড়িতে পা রাখেন। সেই সময়ে রাজবাড়ি শুধু শুটিংয়ের জন্যই ছেড়ে দেননি জমিদাররা, অতিথিদের থাকাখাওয়ারও যথাযথ ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। ১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালে ‘তিন কন্যা’ ও ‘দেবী’ সিনেমার শুটিংও এই বাড়িতেই করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বার বার আসা যাওয়ার জন্য সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে জমিদার পরিবারের সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তার জেরেই তিনি মাঝেমধ্যেই সপরিবারে এখানে এসে উঠতেন। দোতলার ঘরে বসে গঙ্গার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতেন। ১৯২ কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজবাড়িতেই ১৯৬৯ সালে ইন্দো-পাক চুক্তির কমিশন বৈঠক বসেছিল।
কিন্তু এসবই এখন ইতিহাস। পারিবারিক বিবাদ ও অর্থাভাবে এই বাড়ির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে এখন অপারগ এই পরিবারের সদস্যরা। নিত্যদিন এই বাড়িতে ভিড় জমান আশেপাআশের এলাকার ছেলেমেয়েরা। এলাকাবাসীর অভিযোগ দিনের বেলায় প্রেম চললেও রাতে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। সেই সঙ্গে যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় এই বাড়ির বেশ কিছু অংশ যেমন ধসে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে তেমনি কিছু জায়গা বিপদজনকও হয়ে পড়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষজন দাবি করে আসছিলেন এই বাড়িটি যেন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করে সরকার। এই বাড়িটিকে ঘিরে পর্যটন শিল্পও যাতে প্রসারিত হয় তার ব্যবস্থাও করতে দাবি তোলেন তাঁরা। বিষয়টি নজর আসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। তিনি রাজ্য হেড়িটেজ কমিশনকে এই বাড়িটি হেরিটেজ হিসাবে ঘোষণা করা যায় কিনা তা দেখতে বলেন। এরপরেই চলতি বছরের মার্চ মাসে রাজবাড়ি পরিদর্শন করে যান পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রতিনিধিরা। তার পরেই এবার নিমতিতার রাজবাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হল। যদিও গঙ্গা ভাঙনে নদী গর্ভে ইতিমধ্যেই তলিয়ে গিয়েছে এই রাজবাড়ির সঙ্গে থাকা থিয়েটার হল। নদীগর্ভে চলে গিয়েছে রাজবাড়ির তিন-চতুর্থাংশ জায়গাও। তলিয়ে গিয়েছে অতিথিশালা, ঠাকুরবাড়ির দালান, ফুলবাগানও। যা অবশিষ্ট আছে তা-ও নদী গর্ভে চলে যেতে পারে যে কোনও দিন। হেরিটেজ ঘোষণা হওয়ায় এই রাজবাড়ি এ বার যথার্থ মর্যাদা পেলেও আর কতদিন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে তা নিয়ে খটকা থাকছেই।