নিজস্ব প্রতিনিধি: মধ্য আর উত্তর কলকাতার(Kolkata) মিলনস্থল হল মানিকতলা(Maniktala)। সেই মানিকতলাতেই আছে ঘোষ লেন। সেই গলিতেই ঘোষ বাড়িতে(Ghosh Family) ১৮৫৬ সাল থেকে হয়ে আসছে দুর্গাপুজো(Durga Pujo)। সেই পুজোর ছত্রে ছত্রে যেন বিদ্রোহ। ব্যতিক্রমের পর ব্যতিক্রম, কলকাতার আর কোনও বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোয় এত ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। হুগলীর পরঞ্চপুর গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ(Girish Chandra Ghosh)। নির্মাণ করেন বাড়ি। সেই বাড়িতেই ১৮৫৬ সালে দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটান তিনি যা আজও হয়ে আসছে। এই পরিবারের দুর্গা প্রতিমাতে আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য। তিনটে আলাদা আলাদা চালা থাকে প্রতিমার পেছনে। একে বলা হয় মটচৌরি চালা।
এই পরিবারে যে মতে পুজো হয় তাতে দেবী দুর্গা, দেবী সরস্বতী ও দেবী লক্ষ্মীকে ত্রিদেবী ধরা হয়, একই দেবীর তিন রূপ। তাই তাঁদের একটাই বাহন, সিংহ। এখানে তাই লক্ষ্মী ও সরস্বতীর আলাদা করে কোনও বাহন থাকে না। যদিও কার্তিক ও গণেশের বাহণ আছে। লক্ষ্মীর হাতের পদ্মটি আবার মোমের তৈরি। দেবী দুর্গা এখানে পদ্মাসনা। তাঁর ডান দিকে থাকেন সরস্বতী। বাগ দেবীর নীচেই থাকেন কার্তিক। সরস্বতী ও কার্তিকের এই অবস্থান হল সৃষ্টির প্রতীক, মা দুর্গার বাঁ দিকে ওপরে থাকেন লক্ষ্মী, নীচে গণেশ। তাঁদের এই অবস্থান হল স্থিতির প্রতীক। মাঝে দেবী দুর্গা প্রলয়ের প্রতীক। যদিও ঘোষ বাড়িতে তিনি কন্যা রূপেই পূজিতা হন। এই বাড়ির পুজোর সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য যে, এখানে সন্ধি পুজো হয় না। কথিত আছে কোনও এক বছর বাড়ির গুরুদেব সন্ধিপুজো চলাকালীন সময়ে মারা যান। তাই তার পরের বছর থেকে সন্ধিপুজো বন্ধ করে পরিবারের সকল সদস্যের কল্যাণে আয়োজিত হয় কল্যাণী পুজো। তবে সেই পুজোতেও ১০৮ প্রদীপ জ্বালানো হয়।
ঘোষ বাড়ির দুর্গা সজ্জিত হন সাদা রাংতা বা জরির সাজে। কুমোরটুলি থেকে কাঁধে করে মাকে আনা হয়। পরে বাড়ির ঠাকুরদালান তাঁকে রঙ করে সাজিয়ে তোলা হয়। পুজো শুরু হয় পঞ্চমী অথবা ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন দিয়ে। অব্রাহ্মণ বাড়ি তাই অন্নভোগের পরিবর্তে মাকে দেওয়া হয় শীতল ভোগ। যদিও ভোগের লুচি, মিষ্টি ব্রাহ্মণ দ্বারা বাড়িতেই তৈরি করা হয়। পুজোয় ব্যবহৃত সমস্ত প্রদীপের সলতে ও ধূপ বানানো হয় বাড়িতেই। এর মধ্যে ৩৬৫টা তুলো থেকে সুতো বের করে সরু করে পাকিয়ে আড়াই প্যাঁচের সলতে বানানো হয়। অষ্টমীর আরতির সময় ৩৬৫টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই প্রদীপগুলি বছরের ৩৬৫ দিনের সন্ধ্যাবাতির প্রতীক, কোনও কারণে কোনও সন্ধ্যায় বাতি না পড়লে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখানে দেবীর হাতে যে অস্ত্র থাকে তা পিতলের তৈরি। সেই সব অস্ত্র সারা বছর বাড়িতেই থাকে।
এই বাড়ির পুজোয় অষ্টমিতে হয় সধবা পুজো আর ধুনো পোড়ানো। বিজয়া দশমীতে এখানে আবার সিঁদুর খেলার প্রচলন নেই। বাড়ির সধবা এয়ো স্ত্রীরা মাকে বরণ করার পর বাড়র ছেলেরা মাকে কাঁধে চাপিয়ে গঙ্গার ঘাটের উদ্দেশ্যে নিয়ে যান। তবে যে কোনও বস্ত্রে তা করা যায় না। যারা মাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবেন বাড়ির সেই ছেলেদের পড়তে হয় সাদা ধুতি পাঞ্জাবী। তারপর চামর দোলাতে দোলাতে মাকে নিয়ে তাঁরা রওনা দেন গঙ্গার ঘাটে। মাকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে ফিরে হয় শান্তি জল গ্রহণ, প্রণাম ও বিজয়ার কোলাকুলি।