কৌশিক দে সরকার: শহর কলকাতার বয়স এখন প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ছুঁতে চলেছে। সেই শহরের আদি এলাকাগুলিতে এখনও হয়ে চলেছে শতাব্দী প্রাচীন সব পারিবারিক দুর্গাপুজো। সেই সব পুজোর আগেকার জাঁকজমক সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আর চোখে পড়ে না। তবে বজায় রাখা হয়েছে পুজোর রীতিনীতি, নিয়মবিধি। কিছু কিছু পরিবারে বজায় রাখা হয়েছে বনেদিয়ানা এবং আভিজাত্যও। এখানে থাকলো কলকাতার বুকে এখনও শিরোনামে থাকা এক ডজন পুজো বাড়ির কথা।
শোভাবাজার রাজবাড়ি: উত্তর কলকাতার বুকে বনেদিয়ানা আর আভিজাত্যের সব থেকে বড় প্রতীক শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। এই রাজ পরিবারের দুটি ভাগ রয়েছে, বড় তরফ ও ছোট তরফ। দুই পরিবারের দুটি ভিন্ন ভিন্ন বাড়ি। দুটিতেই হয় দুর্গাপুজো। বড় তরফ মূলত শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেবের দত্তক পুত্র গোপীমোহন দেবের বংশধরেরা। ছোট তরফ রাজা নবকৃষ্ণের নিজ পুত্র রাজকৃষ্ণ দেবের বংশধরেরা। রাজা নবকৃষ্ণ ১৭৫৭ সালে বড় তরফের বাড়িতেই প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। তবে পরবর্তীকালে তিনি ছোট তরফের বাড়িতেও পুজোর প্রচলন করেন। সেটি তাঁর নিজ পুত্রের বংশধরদের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে বলে এটিই শোভাবাজারের মূল রাজবাড়ির পুজো হিসাবে চিহ্নিত।
পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ি: উত্তর কলকাতার আরেক অন্যতম বনেদিয়ানা আর আভিজাত্যের প্রতীক হল পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ি। সেই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খেলাৎ ঘোষ। তিনি ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান। আর সেই সুবাদেই প্রচুর অর্থের মালিকও হয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির পত্তন ও দুর্গাপুজোর সূচনা। এখনও এবাড়িতে যথাযথ রীতি মেনে হয়ে চলেছে পুজো।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো: কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পুজো আজও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে বড়িশার বুকে। সেই পুজো সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আটচালার পুজো নামেই পরিচিত। যদিও এই বংশের সদস্যরা বহু শাখায় প্রশাখায় বিভক্ত এবং তাঁদের পরিবারেও দুর্গাপুজো হয়। তবে আটচালার পুজোই বংশের মূল পুজো বলে আজও চিহ্নিত হয়ে চলেছে। এই বংশের সদস্য লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার মুঘন সেনাপতি রাজা মানসিংহের তরফ থেকে জমিদারি ও রায় চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। তারপরেই ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্তের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো, যা আজও হয়ে চলেছে।
জোড়াসাঁকোর নরসিংহচন্দ্র দাঁ বাড়ির পুজো: বাঁকুড়া জেলার কোতলপুর থেকে কলকাতায় এসে প্রথমে মশলা আর পরে গোলাবারুদের ব্যবসা শুরু করেছিলেন নরসিংহচন্দ্র দাঁ। সেই সূত্রেই জোড়াসাঁকোতে বানিয়েছিলেন বাড়ি। পরবর্তীকালে সেই বাড়িতেই ১৮৫৯ সাল থেকে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন নন্দলাল দাঁ। এখনও এই বাড়িতে যথাযথ রীতি মেনেই পুজো হয়ে চলেছে। এই বাড়ির পুজোর বৈশিষ্ট্য যে এখানে দেবী দুর্গাকে কন্যারূপে পুজো করা হয়। সন্ধিপুজোর শুরু, সন্ধিক্ষন মুহুর্ত ও সন্ধিপুজোর শেষে আজও এই বাড়ির ছাদ থেকে বন্দুক ও কামান দাগা হয়। মায়ের বিসর্জনের সময়ও দাগা হয় কামান ও বন্দুক।
হাঠখোলা দত্ত বাড়ির পুজো: দেওয়ান জগৎরাম দত্তের হাতে পত্তন হওয়া উত্তর কলকাতার হাঠখোলা এলাকার দত্ত বাড়ির আরও বড় এক পরিচয় রয়েছে। এই বাড়ি ও পরিবার দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর মামারবাড়ি। সেই বাড়িতেও বিগত ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হয়ে চলেছে দুর্গাপুজো। এই বাড়ির পুজো একসময় পরিবারের কুলগুরু নামে সংকল্প করে হত। তাঁর পরিবারের সদস্যরাই এই পুজোর পরিচালনায় থাকতেন। পরে অবশ্য দত্ত বাড়ির সদস্যদের নামেই সংকল্প হওয়া শুরু হয়, তবে আজও এই বাড়ির সদস্যরা সেভাবে পুজো পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন না।
ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ির পুজো: পুজোর পরিচিতি ছাতুবাবু লাটুবাবুর পুজো বলে। কিন্তু সেই পুজোর প্রচলন করেছিলেন তাঁদের বাবা রাম দুলাল দে, ১৭৭০ সালে। রামবাবুর বাংলার প্রথম কোটিপতি মানুষ ছিলেন। তাঁর পরে এই পুজো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন ছাতুবাবু আর লাটুবাবু যারা আশুতোষ দে ও প্রমথনাথ দে নামেও পরিচিত ছিলেন। এই বাড়ির প্রতিমায় মা দুর্গার সঙ্গে থাকেন না লক্ষ্মী ও সরস্বতী। পরিবর্তে থাকেন জয়া ও বিজয়া।
ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ি: মহিষাসুরমর্দিনী নয়, উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়িতে দেবী দুর্গা পূজিত হন তাঁর স্বামী ও ছেলেমেয়ের সঙ্গে হরগৌরী রূপে। যেন মেয়ে জামাই সপরিবারে পুজোর চারদিন কাটাতে এসেছে। হরের শ্বশুরবাড়ি ও গৌরীর বাপের বাড়ি। এ বাড়ির পুজোর অন্যতম দুই বৈশিষ্ট্য হল অষ্টমিতে বাড়ির মহিলাদের ‘ধুনো পোড়ানো’র প্রথা ও নবমীর পুজো শেষে সধবা পুজোর রীতি।
দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির পুজো: শহর কলকাতার বুকে যেন একটুকরো বিপ্লব। কেননা এবাড়ির পুজোতে হর্তাকর্তা বিধাতা বাড়ির মহিলারাই। এই পুজোর সঙ্গে নেই কোনও শরিকি যোগ, আছে ভক্তি, রীতিনীতি আর বাড়ির মহিলাদের যোগদান পর্ব। রাধাকৃষ্ণ মিত্রের হাত ধরে চালু হওয়া এই পুজো এখনও দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়িতে সুশোভিত ঠাকুরদালানে হয়ে চলেছে পারিবারিক নিয়মমেনেই। এবাড়ির বিজয়া দশমীর দিন মাকে বরণ করার সময়ে বাড়ির মহিলারাই মাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করেন।
পাতালডাঙার বসুমল্লিক বাড়ির পুজো: কলেজ স্কোয়ারের পাশে থাকা সূর্য সেন স্ট্রিটের পাশেই রয়েছে পাতালডাঙা এলাকা। সেখানকার বসুমল্লিক পরিবারের পুজো যেন বাংলার এক জীবন্ত ইতিহাস। বসুমল্লিকদের সেখানে দুটি বাড়িতে দুই তরফের লোকেরা থাকেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হল ‘শিবালয়’ বাড়িটি যা ক্ষেত্রচন্দ্র বসুমল্লিক তৈরি করেছিলেন। সঙ্গে চালু করেছিলেন দুর্গাপুজো। কাস্ট আয়রন আর বেলজিয়াম গ্লাসের তৈরি এই বাড়ির ঠাকুরদালান কলকাতার অন্যতম সেরা দুর্গাদালান।
রাজাবাজার মুখার্জি বাড়ির পুজো: চন্দননগরের গোন্দলপাড়া থেকে কলকাতার রাজাবাজারে উঠে এসে প্রাসাদপম বাড়ি বানিয়েছিলেন হরিনাথ মুখার্জি। শুধু বাড়ি বানানোই নয়, সুশোভিত ঠাকুরদালান গড়ে সেখানে চালু করেছিলেন দুর্গাপুজোও। সেই পুজোও দেখতে দেখতে ৩০০ বছর অতিক্রম করে দিয়েছে। সময়ের গতিতে সেই বাড়ির পুজো থেকে অনেক জৌলুষ হারিয়ে গেলেও রয়ে গিয়েছে নিষ্ঠা, ভক্তি আর শ্রদ্ধা সহযোগে দুর্গাপুজোর রীতি।
কলুটোলা বদনচন্দ্র রায়বাড়ির পুজো: বিগত দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্গাপুজো হয়ে চলেছে মধ্য কলকাতার কলুটোলা এলাকার বদনচন্দ্র রায়ের বাড়িতে। কলুটোলা এলাকার গোপালচন্দ্র লেনে গড়ে ওঠা অপূর্ব সুন্দর দুর্গাদালান আজও বাড়ির ঐতিহ্য আঁকড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাঁচ খিলানের দুর্গাদালানের শোভা আরও বাড়িয়েছে উঠোনের ঝাড় আলোর স্তম্ভ আর কাস্ট আয়রেনের গার্ডওয়াল।
জোড়াসাঁকো কুণ্ডুবাড়ির পুজো: রাসমণি দাসী ছিলেন জোড়াসাঁকো কুণ্ডু বাড়ির গিন্নি। তাঁর স্বামী কৃষ্ণদাস কুণ্ডু ছিলেন কেরোসিনের ডিলার। রাসমণির বাপের বাড়িতে দুর্গাপুজো হলেও শ্বশুরবাড়িতে তা হত না। কেরোসিনের ব্যবসায় অর্থের মুখ দেখা কৃষ্ণদাস স্ত্রীর ইচ্ছাতে ১৮৭৯ সালে তাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। এই বাড়ির ঠাকুরদালান আকার আয়তনে একটু ছোট হলেও তা বেশ নান্দনিক শিল্পকলায় সমৃদ্ধ।