নিজস্ব প্রতিনিধি: ১০৮টি পদ্মফুল লাগে না পুজোর আয়োজনে, দুর্গার রূপ প্রতিবছর একই থাকে। শোভাবাজারের মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজোর নিয়মে অভিনবত্ব রয়েছে আরও অনেক। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে যে বিষয়টি, পুজোর দায়িত্ব বাড়ির মেয়েদের। শহর কলকাতায় আর যে ক’টি বনেদি বাড়ির পুজো রয়েছে তার কোনওটিতেই এমন চল নেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলার ‘কোর্ট জুয়েলার’ দুর্গাচরণ মিত্রের বাড়ির পুজোর ইতিহাসও রয়েছে অনেক।
জানা যায়, দুর্গাচরণ মিত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র নীলমণি মিত্র একবার ইংরেজ সরকারের এক অনুরোধ পূরণ করতে না পারায় ব্রিটিশরা তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। সেই সময় পরিবার নিয়ে তিনি বেনারসে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু নীলমণি মিত্রের মৃত্যুর পর বিধবা পুত্রবধূ তাঁর ছেলেদের নিয়ে কলকাতায় দুর্গাচরণ মিত্রের বাড়িতে ফিরে আসেন। আর সেখানেই একদিন নীলমণি মিত্রের বড় নাতি প্রাণকৃষ্ণ মিত্র খেলার ছলে বন্ধু প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে বসে কালী প্রতিমা তৈরি করেন। পরে এই দেবীকে পুজো করা হয়। এই পুজোর পরে আবারও পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এরপর নীলমণি মিত্রের ছোট নাতি তথা রামদুলাল সরকারের জামাই সে যুগের নামকরা আমদানি-রফতানির ব্যবসায়ী রাধাকৃষ্ণ মিত্র ১৮০৬-এ দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির দুর্গোৎসবের সূচনা করেন।
পরবর্তী সময়ে রাধাকৃষ্ণের মেজ ছেলে রাজকৃষ্ণ মিত্র এই পুজোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণ মিত্রের পঞ্চম বংশধরের কোনও ছেলে না থাকায় এখন বাড়ির মেয়েরাই এই পুজোর পরিচালনা করে থাকেন। এবছর সেই পুজো ২১৫ বছরে পা দিল।
পাঁচ খিলানের দু’দালান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান। বাইরের দালানের সম্মুখভাগের অলঙ্করণ করা ছিল, যা এখন আর নেই। এবাড়ির প্রতিমা তিনচালার। প্রতিমার পিছনে মঠচৌরির কাজ রয়েছে। অর্থাৎ মাটির নকশা করা তিনটি মঠের চূড়ার আকৃতির চালি। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর দেবীমুখ ও কার্তিক ও অসুরের মুখ সাধারণ মানুষের মতোই। তবে চোখগুলি দেবীমুখের আদলে টানা টানা। দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। সিংহের মুখ ড্রাগনাকৃতি। এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে প্রতিমার মুখের ছাঁচ বংশ পরম্পরায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ওই ছাঁচ ব্যবহার করেই প্রতিমার মুখ তৈরি করা হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, মিত্র বাড়ির পুজোর আয়োজনে ১০৮টি পদ্ম লাগেনা, পরিবর্তে ১০৮টি নীল অপরাজিতা ফুল ব্যবহার করা হয়।
বাড়িতে পুজো হয় বৈষ্ণব মতে, তাই পিতৃপক্ষের তর্পণের পর থেকে দশমীতে ঠাকুর ভাসান পর্যন্ত বাড়িতে পেঁয়াজ, রসুন, মাছ-মাংস, ডিম ঢোকা বারণ। আবার কচু, চালকুমড়ো, কাঁঠাল এগুলিও খাওয়া বারণ। তাই এই পুজোতে নবমীতেও ভোগ হয় নিরামিষ। আগে এই বাড়িতে ছাগ বলির প্রচলন ছিল। একবার রাজকৃষ্ণ মিত্রের পায়ের কাছে ছাগল এসে আশ্রয় নেওয়ায় সেই বার থেকেই পশুবলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। ভোগে থাকে খিচুড়ি আর তরকারি। সঙ্গে ষষ্ঠীতে সাবুর পায়েস, সপ্তমীতে আটার হালুয়া, অষ্টমী ও নবমীতে পায়েস, ও দশমীর দিন মিষ্টি দই দিয়ে খই মাখা। আর পুজো শুরুর দিন থেকে সন্ধিপুজো পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই মাখন-মিছড়ির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। বাড়ির সদস্যদের থেকে জানা যায়, এই বাড়ির পুজোতে একবার লর্ড কর্নওয়ালিস এসেছিলেন। মা সারদা মিত্র বাড়ির পুজোর পরমান্ন রেঁধেছিলেন।
একান্নটা ঢাকের আরতি করতে হয় ঠাকুরকে। দশমীর দিন তৈরি করা হয় ঝাড়খিলি।
একটি পান-পাতার শিরাগুলি রেখে পাতাটিকে ভাগ করে ওতেই তৈরি হয় ছোট ছোট পাঁচটি খিলি। দশমীর দেবীবরণের পর প্রতিমার মুখে দেওয়া হয় সুগন্ধি ছাঁচিপান আর হাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এই ঝাড়খিলি। প্রথমে দুর্গা, তার পর একে একে অন্য প্রতিমার হাতে। দশমীতে মোট সাতাশটি পানের ঝাড়খিলি তৈরি করা। প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় পুরুষদের পরণে থাকে ধুতি, উড়ুনি আর হাতে থাকে লাঠি। ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে ফেরার পথে জোড়া মাছ, তেল-হলুদ কিনে আনার রেওয়াজ আছে আজও। বাড়ির উঠোনে সেই জোড়া মাছ রান্না করা হয়। দশমীর রাতে ওই মাছের ঝোল খেয়ে ন’দিনের নিরামিষ ব্রত শেষ হয় মিত্র বাড়ির।