সুস্মিতা ঘোষ, নবাবগঞ্জ, ইছাপুর: দেখতে দেখতে পুজো শেষের পর্যায়ে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। তাই সারা বছর এই পুজোকে ঘিরে বহু পরিকল্পনা থাকে বাঙালি দের। দুর্গাপুজো মানেই কলকাতা, তিলোত্তমা পরিক্রমা। উত্তর থেকে দক্ষিণে কত রাত পর্যন্ত প্যান্ডেল হপিং চলবে, কোথায় কী পুজো হয়েছে, কোন থিম অভিনব, মোট ক’টা ঠাকুর দেখা যাবে একদিনে তা নিয়ে চলে বিস্তর আলোচনা।
কিন্তু শেষমেষ লাগামছাড়া ভিড় আর লম্বা লাইন সব প্ল্যানেই যেন জল ঢেলে দেয়। তবে সবাই যে থিম পুজোতেই বিশ্বাসী তা কিন্তু নয়, একটু পুরোনো দিনের মানুষ হোক বা কোনও ক্রিয়েটিভ তরুণ-তরুণী, তাঁরা কিন্তু দুর্গা পুজোর সময়ে বনেদি বাড়ির পুজোর খোঁজে থাকেন।
কারণ এ সব থিম পুজো এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস বা কোনও নতুন তথ্য যদি মানুষকে জানানো যায়, সেটাও কিন্তু এক ধরণের নস্টালজিয়া। তাই আজ আমরা আপনাদের নিয়ে যাব, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ইছাপুর নবাবগঞ্জ (Nawabganj Rajbari) রাজবাড়িতে। যাঁদের বাড়ির পুজো আনুমানিক ২১৫ বছর। আজও একই নিয়মে একই যাদুবলে এখানে দুর্গা মা পূজিত হন। বর্তমানে এই রাজবাড়ির দশম প্রজন্ম রয়েছে। সবথেকে প্রবীণের বয়স ৯০ বছর। সব মিলিয়ে তাঁদের বাড়ির সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন। তবে সকলে সারাবছর একসঙ্গে না থাকলেও বাড়ির পুজোর সময় সবাই মিলিত হন। এই পুজোর রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। বাড়ির মানুষ মনে করেন মায়ের সমস্ত দৃষ্টি তাঁদের মধ্যে রয়েছে। তবে এখানে মায়ের নিত্যপুজো নাহলেওও নারায়ণ শিলাতে পুজো হয় প্রতিদিন। দুর্গা পুজোর সময় সেই নারায়ণ শিলা নিচে নেমে আসে।
এই বাড়ির দশম প্রজন্ম পার্থ কুমার মণ্ডলের কথায়, “ইংরেজদের সময়েই শুরু হয় এই বাড়ির পুজো। প্রথমে এই পুজো বাড়ির জমিদার মাটির আটচালাতে করতেন। এর ঠিক ১১ থেকে ১৪ বছর পর তাঁর ছেলে শ্রীধর বংশীধর এই পুজো মূর্তিতে রূপান্তর করেন। বিশেষত তাঁরা ছিলেন ব্যবসায়ী, বাণিজ্যই ছিল তাঁদের ধ্যান জ্ঞান। একসময় তাঁদের ব্যবসার এতটাই উন্নতি হয়েছিল যে, তাঁরা আটচালা তুলে দিয়ে মায়ের মূর্তি পুজো করবেন বলে ঠিক করেন। তখনই ঠাকুর দালান নির্মাণ করেন শ্রীধর বংশীধর। ইছাপুরই তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায়। শুরু করেন বৈষ্ণব ধর্মমতে মায়ের পুজো, তাই এই রাজবাড়িতে মা রুদ্রমূর্তি বা মহিষাসুরমর্দিনী রুপে পূজিত হন না। তাই বলিও দেওয়ার নিয়ম নেই। অর্থাৎ হিংসা নয়, বাড়ির মেয়ে হিসেবে পূজিত হন দুর্গা। শিব-পার্বতী কে একসঙ্গেই পুজো করা হয় এখানে। এইভাবেই ২১৫ বছর ধরে এখানে পুজিত হয়ে আসছেন। রথের দিন থেকে মায়ের নির্মাণ কার্য শুরু হয়। এরপর ঠাকুর দালানেই তৈরি করা হয় মাকে। আকর্ষণীয় বিষয়, যে সকল মৃৎ শিল্পী মায়ের মূর্তি তৈরি করেন তাঁরা সে সময় মাছ বা মাংস ছুঁতে পারেন না। এটাই নিয়ম এই রাজবাড়ির। মহালয়া থেকে বাড়ির সমস্ত সদস্য নিরামিষ ভোজন করেন এবং ষষ্ঠীর আগে থেকেই তাঁদের অন্ন খাবার ত্যাগ করতে হয়।”
এরপর দশমীতে মায়ের বিসর্জনের পর আমিষ খেতে পারেন তাঁরা। তবে বর্তমানে অনেক নিয়ম কানুন লোকজনের অভাবে করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু বাড়ির মহিলারা সবাই হাতম হাত দিয়ে পুজো করেন। এই বাড়ির আরও এক সদস্যের কথায়, “মজার বিষয় হল, এই রাজবাড়ির দেবী দুর্গা তাঁর নিজের টাকায় পূজিত হন। কারণ এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীধর বংশীধর মায়ের নামে বিপুল সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন। সারা বছর এই সম্পত্তি ব্যবসায় খাটিয়ে যে লাভ হয় তাতেই পুরো পুজো কাজগুলো হয়ে যায়। এছাড়াও দুর্গা পুজোর আগে এখানে ১৫ দিনের ঝুলন মেলা হত। কিন্তু আর হয় নাা।”
তাঁদের একটি গোপীনাথ মন্দিরও রয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে বাড়ির সকলে এক হন।খাওয়া-দাওয়া হয়। অষ্টমীর দিন লুচি সহ একাধিক ভোগ পরিবেশন করা হয়। এবং তাতে অন্নের ছিটেফোটারও রাখার নিয়ম নেই। দেবীর বিসর্জনের দিন মাঝ গঙ্গায় দুটি নৌকোর মাঝে মাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তার আগে গঙ্গার উত্তর থেকে দক্ষিণ মাকে ৩ বার প্রদক্ষিণ করানোর নিয়ম, যা আজও সেই বাড়ির সদস্যরা ধরে রেখেছেন। তবে এখনও মায়ের স্বপ্নাদেশ পান সেই বাড়ির লোকজন। কোন ভুল ত্রুটি হলে মা নিজেই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। প্রচুর মনের ইচ্ছে পূরণও হয়েছে সদস্যদের।
আজ মহাষ্টমীতে তাঁদের বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল সকাল থেকেই, দুপুর সাড়ে চারটের দিকে হয়েছে সন্ধি পুজো। সব মিলিয়ে এই রাজবাড়ির পুজো আরও ১০০ বছর এগিয়ে যাক তাও কামনা করি।