এই মুহূর্তে




জানেন কী, ভারতের বুকেই আছে পিসার টাওয়ারের থেকেও বেশি হেলানো মন্দির?




নিজস্ব প্রতিনিধি: ইতালির বিখ্যাত পিসার হেলানো টাওয়ার কে না চেনে ? যে টাওয়ার হেলে রয়েছে ৫ ডিগ্রি। তবে জানেন কী,পূণ্য তীর্থ ভারতের বুকেই এমন এক প্রাচীন মন্দির আছে, যা পিসার টাওয়ারের থেকেও প্রায় দ্বিগুণ হেলে আছে? হ্যাঁ, এই মন্দির আছে ভারতের অন্যতম প্রাচীন তীর্থনগরী বারাণসীতে। বারাণসীর রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির (रत्नेश्वर महादेव मंदिर), যা অনেকের কাছেই “মাতৃঋণ মহাদেব” কিংবা “বারাণসীর হেলানো মন্দির” নামে পরিচিত – যা এক অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন। গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই মন্দিরটি কেবলমাত্র তার ধর্মীয় গুরুত্বের জন্যই নয়, বরং এর অভাবনীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য এবং ৯ ডিগ্রির বেশি হেলে থাকার জন্যও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 অবস্থান ও প্রেক্ষাপট

রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দিরটি বারাণসীর মণিকর্ণিকা ঘাটে তারকেশ্বর মহাদেব মন্দিরের একেবারে সামনেই অবস্থিত। এই দুই মন্দিরের মাঝখানে একটি ফাঁকা স্থান রয়েছে যা ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ মুদ্রা পরীক্ষক জেমস প্রিন্সেপ ১৮৩২ সালে তাঁর একটি অঙ্কনে এই স্থানটিকে বারাণসীর “সবচেয়ে পবিত্র স্থান” হিসেবে উল্লেখ করেন। এই অঞ্চলটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গণ্য হয়েছে। বিশেষ করে মণিকর্ণিকা ঘাট মৃত্যুর পর আত্মার মোক্ষ লাভের পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখানকার প্রতিটি স্থাপত্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণশৈলী

রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির নির্মিত হয়েছে ধ্রুপদী স্থাপত্যশৈলীতে, বিশেষ করে নাগর শিখর ও মার্জিত মণ্ডপ বৈশিষ্ট্যে। মন্দিরটি গঙ্গার তীরে অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানে নির্মিত, যা বারাণসীর অন্য মন্দিরগুলোর ব্যতিক্রমী। এর ফলে বর্ষাকালে গঙ্গার জলস্তর বেড়ে গেলে মন্দিরটির গর্ভগৃহ প্রায় পুরোপুরি জলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এই দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল এবং মন্দির নির্মাতারা সচেতনভাবেই এমন নকশা গ্রহণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সাধারণত বছরের অধিকাংশ সময় মন্দিরের গর্ভগৃহ জলের নিচে থাকলেও এর স্থাপত্য এখনও সুসংরক্ষিত রয়েছে। তবে এর পশ্চাৎ অংশ তথা উত্তর-পশ্চিম কোণ ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে। আধুনিক চিত্র ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মন্দিরটি প্রায় ৯ ডিগ্রি কোণে হেলানো, যা স্থাপত্যশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে এক বিস্ময়কর ঘটনা।

 ইতিহাস ও নির্মাণকাল

মন্দিরটির সঠিক নির্মাণকাল নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও বেশিরভাগ ঐতিহাসিক সূত্র বলছে, এটি ১৮২৫ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। যে তথ্য বারাণসীর রাজস্ব রেকর্ডে পাওয়া যায়। আবার জেলা সাংস্কৃতিক কমিটির সদস্য ডাঃ রত্নেশ ভার্মার মতে, ১৮৫৭ সালে আমেঠি রাজপরিবার এই মন্দির নির্মাণ করে। অন্যদিকে কিছু ইতিহাসবিদ দাবি করেন, গোয়ালিয়রের রানি বাইজা বাই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৬০-এর দশকে তোলা আলোকচিত্রে মন্দিরটিকে সোজা অবস্থায় দেখা গিয়েছে, যা থেকে অতি সহজেই বোঝা যায় যে ক্রমশ হেলে পড়ার প্রক্রিয়াটি পরবর্তীকালে শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মন্দিরটির ভিত্তি ত্রুটিযুক্ত ছিল এবং মাটির স্তরে পলিমাটির সরে যাওয়াই হেলে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

কিংবদন্তি ও লোককথা

রত্নেশ্বর মন্দির ঘিরে প্রচলিত আছে নানা কিংবদন্তি। একটি জনপ্রিয় উপাখ্যান অনুসারে, প্রায় ৫০০ বছর আগে রাজা মান সিংহের এক রাজকর্মচারি তার মা রত্না বাইয়ের উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দির নির্মাণের পর তিনি গর্ব করে বলেন, “আমি আমার মাতৃঋণ শোধ করেছি।” সেই কথাই নাকি কাল হয়ে ওঠে। তাই অনেকে বলে থাকেন, মায়ের অভিশাপেই নাকি মন্দিরটি উত্তর-পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে । এই কারণে মন্দিরটি “মাতৃঋণ মহাদেব” নামেও পরিচিত।

আবার, অন্য একটি উপাখ্যানে বলা হয়, ইন্দোরের রানী অহল্যাবাঈ হোলকারের এক দাসী রত্না বাই এই মন্দির নির্মাণ করেন এবং নিজের নামে নামকরণ করেন। এতে রানী অহল্যাবাঈ অসন্তুষ্ট হন এবং অভিশম্পাত দেন, যার ফলে মন্দিরটি হেলে পড়েছে।

 প্রাকৃতিক প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি

২০১৫ ও ২০১৬ সালে প্রবল বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাতে মন্দিরটির শিখর অংশ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গঙ্গার জলে নিমজ্জিত অবস্থাতেও মন্দিরটি আজও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি প্রমাণ করে যে, নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান এবং স্থাপত্য দক্ষতা কতটা উন্নত ছিল।

 চিত্র ও পর্যবেক্ষণ

১৮২০-১৮৩০ সালের সময়ে জেমস প্রিন্সেপ বেনারস টাকশালের মুদ্রা পরীক্ষক ছিলেন এবং তিনি বারাণসীর বিভিন্ন স্থাপনার চিত্র আঁকেন। তাঁর এক চিত্রে রত্নেশ্বর মন্দির অন্তর্ভুক্ত, যেখানে দেখা যায়, পুরোহিতগণ পূজার জন্য জলে ডুব দিচ্ছেন। কারণ মন্দির প্রবেশদ্বার তখন জলের  নিচে।

 বিশ্বজনীন তাৎপর্য ও উপেক্ষা

যেখানে পিসার হেলানো টাওয়ার নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়, সেখানে রত্নেশ্বর মন্দিরের মতো একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য প্রায় অজানাই থেকে গিয়েছে। এই মন্দির আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতীয় স্থাপত্যশিল্প কতটা সমৃদ্ধ এবং প্রকৃতি, ধর্ম ও বিশ্বাসের এক অপূর্ব সংমিশ্রণেই গড়ে উঠেছে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন। তাই নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ভারতের স্থাপত্য ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সাক্ষ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলে নিমজ্জিত অবস্থাতেও মন্দিরের অস্তিত্ব বজায় থাকায় এটি এক বিস্ময়কর কীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। এই মন্দির কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আস্থার প্রতীক নয়, বরং বৈজ্ঞানিক, স্থাপত্যিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এক অমূল্য রত্ন। ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে এমন স্থাপনাগুলোর যথাযথ প্রচার ও সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

‘ভারত আগে ছিল, আগেই থাকবে’, বাড়ি ফেরার পথে জানিয়ে গেলেন পূর্ণম

নির্মম! গাছের নিচে ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির উপর ময়লা ফেলে নৃশংসভাবে খুন পুরকর্মীর

‘ভেঙে পড়েছে ভারতের বিদেশনীতি’, বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে তীব্র আক্রমণ রাহুল গান্ধির

জামিন মিলতেই গণধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তদের নিয়ে বিজয় মিছিল, লজ্জার ঘটনা কর্নাটকে

জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার আপ বিধায়ক রমন অরোরা

সোনিয়া-রাহুলের সংস্থায় কংগ্রেস নেতাদের অনুদান দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, দাবি ইডির

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ