এই মুহূর্তে




এই প্রাচীন শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গে দেওয়া হয় তুলসীপাতা… কেন জানেন ?




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ভারতের অতি প্রাচীন শহর ভুবনেশ্বর। জানা যায়, উড়িষ্যার রাজধানী এই ভুবনেশ্বর হল সুবিখ্যাত শৈবতীর্থ। এই শহরে অবস্থিত লিঙ্গরাজ মন্দির পূর্ব ভারতের প্রাচীন মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম। বলতে গেলে এই মন্দির পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের থেকেও ৪৫০ বছর আগে নির্মিত। সংস্কৃতি পুঁথির থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করা হয় সুবিশাল এই মন্দির। এই দেবালয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, এর সঙ্গে কলিঙ্গ স্থাপত্যের মিল রয়েছে।

“লিঙ্গরাজ” (Lingaraj)  শব্দের আক্ষরিক অর্থ লিঙ্গের রাজা অর্থাৎ, হিন্দুমতে ভগবান শিবের প্রতিরূপ। তাঁকে ত্রিভুবনেশ্বরও বলা হয়, যার অর্থ স্বর্গ, মর্ত ও শূন্যলোকের তথা ত্রিভুবনের অধিপতি। তাঁর অর্ধাঙ্গিনীই হলেন স্বয়ং ভুবনেশ্বরী। অপরদিকে “ভুবনেশ্বর” নামেরও একটি গভীর অর্থ রয়েছে। এটি সংস্কৃত শব্দ “ভুবন” অর্থ “পৃথিবী” এবং “ঈশ্বর” অর্থ “প্রভু” থেকে এসেছে। তাই, ভুবনেশ্বর অনুবাদ করলে তার অর্থ দাঁড়ায় “পৃথিবীর প্রভু” অর্থাৎ, ভুবনেশ্বরই হলেন স্বয়ং শিব । উল্লেখ্য, ভুবনেশ্বর তথা সমগ্র উড়িষ্যারই বৃহত্তম মন্দির হল লিঙ্গরাজ। জানা যায়, সপ্তম শতকের কিছু সংস্কৃত পুঁথিতে মন্দিরটির উল্লেখ আছে। অনেক ঐতিহাসিকের দাবি, এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন  ললাট ইন্দু কেশরি, যিনি ৬১৫ থেকে ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত উড়িষ্যার শাসক ছিলেন। তবে এই লিঙ্গরাজ মন্দিরের নাটমন্দির ও দু’টি গম্বুজ দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি করা হয়েছিল বলে অনুমান। সেই সময়েই পুরীতে নির্মিত হয়েছিল শ্রী জগন্নাথ মন্দির।

লিঙ্গরাজের বিশেষত্ব – কেন শ্রী লিঙ্গরাজ অন্যান্য শিবমন্দির থেকে আলাদা ?

মন্দিরের ভূমি থেকে ১৮০ ফুট উঁচু লিঙ্গরাজ মন্দিরটিকে সুপরিচিত সমালোচক এবং ঐতিহাসিক জেমস ফার্গুসন ভারতের বিশুদ্ধ হিন্দু মন্দিরসমূহের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মন্দিরের মিনারটি ১৪৮ ফুট মিনারের কোনো একটি স্থানও ভাস্কর্য ও অলঙ্করণের জন্য বাকি নেই, এর প্রত্যেক ইঞ্চি নিখুঁত ভাবে নকশাকৃত। জানা যায়, মন্দিরে প্রবেশপথের দরজাটি নির্মিত চন্দনকাঠ দিয়ে।

মন্দিরটি পূর্বমুখী এবং চুনাপাথরে তৈরী। মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথটি পূর্বে হলেও উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ছোট প্রবেশপথ আছে। মন্দিরটির পূর্ব-পশ্চিম অভিমুখ কোন কাকতালীয় নয়। এটি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সাথে পুরোপুরি সারিবদ্ধ, এর ফলে মন্দিরের মধ্যে সূর্যালোক যথেষ্ট মাত্রায় প্রবেশ করে। লিঙ্গরাজের মূল মন্দিরটি দেউল শৈলীতে নির্মিত, যার চারটি অংশ বর্তমান। সর্বপ্রথম হল বিমান, তারপরে ভক্ত জমায়েতের স্থানটির নাম জগমোহন, তারপরের অংশটি নাটমন্দির এবং সর্বশেষ অংশটি ভোগ মণ্ডপ। এই চারটি অংশই একই অক্ষে অবস্থিত। 

মূল মন্দিরের গর্ভগৃহেই অধিষ্ঠিত লিঙ্গরাজরুপী স্বয়ং মহাদেব। বিশালাকার এই লিঙ্গরাজকে বেলপাতার সাথে অর্পণ করা হয় তুলসী পাতাও। কারণ, এই মন্দিরে প্রধান দেবতা লিঙ্গরাজ লিঙ্গের ওপরে অবস্থিত শালিগ্রাম অর্থাৎ, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, সৃষ্টির পালনকর্তা বিষ্ণু ও ধ্বংসকর্তা শিব এই দুজনে একসাথে পূজিত হন। এই মন্দিরে হিন্দুধর্মের দুটি ধারা শৈবধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের মিলন ঘটেছে।

স্থানীয়দের বিশ্বাস অনুসারে, যে স্থানটিতে এই মন্দিরটি রয়েছে, সেটি একসময় একটি পবিত্র বন ছিল, যেখানে ভগবান শিব ভগবান বিষ্ণুকে নিয়ে একটি লিঙ্গের আকারে বা ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, ভক্তরা এই পবিত্র স্থানে ভিড় করে, এবং ধীরে ধীরে এই অভূতপূর্ব মন্দির তৈরি করা হয়।

হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে, একটি ভূগর্ভস্থ নদী লিঙ্গরাজ মন্দিরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিন্দুসাগরে এসে পড়েছে এবং বিশ্বাস করা হয়, এর জল দৈহিক ও আত্মিক অসুস্থতা দূর করার ক্ষমতা রাখে। পুকুরের জলকে পবিত্রজ্ঞান করা হয় এবং উৎসব মৌসুমে তীর্থযাত্রীরা এই পুকুরে পবিত্রস্নান করে থাকে। এছাড়াও এই মন্দিরে গণপতি, বিষ্ণু, নন্দী, প্রভৃতি বহু অপ্রধান মন্দিরও আছে। মন্দিরটির বিভিন্ন দিকে কার্তিক, গণেশ এবং দেবী পার্বতীর মূর্তি সারিবদ্ধ ভাবে স্থাপিত।

লিঙ্গরাজ মন্দিরের উৎসব সমূহ :

লিঙ্গরাজ মন্দিরের প্রধান উৎসব হচ্ছে শিবরাত্রি, যা ফাল্গুন মাসে প্রতিবছর আয়োজন করা হয়। এই মহাশিবরাত্রিতে লক্ষাধিক ভক্তপ্রাণ মানুষের জমায়েত হয় মন্দিরে। সারাদিনের উপবাস শেষে এই বিশেষ দিনে লিঙ্গরাজকে বেলপাতা নিবেদন করা হয়। এই দিনে মন্দির চত্ত্বরে মহাদ্বীপ প্রজ্জ্বলনের পর ভক্তদল তাদের উপবাস ভঙ্গ করে। জানা যায়, প্রতি শ্রাবণ মাসে অগণিত ভক্তরা পায়ে হেঁটে মহানদী থেকে জল বয়ে নিয়ে আসে এই মন্দিরে। চন্দন যাত্রার সময় মন্দিরের সেবায়েতরা বিন্দুসাগরে বিশেষভাবে নির্মিত নৌকায় অবস্থান করে। তখন লিঙ্গরাজকে বিশেষ উপাচারে চন্দনবাটা মাখানো হয়। টানা ২২ দিন ধরে চলে এই উৎসব।

প্রতিবছর অশোকাষ্টমীতে লিঙ্গরাজ মন্দিরে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই রথযাত্রায় হলুদ ও লাল রঙে নির্মিত সুসজ্জিত রথে লিঙ্গরাজ ও তার বোন রুকমনির মূর্তিকে রথে চড়িয়ে রামেশ্বর দেউল মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

এছাড়াও ভাদ্র মাসে পালিত হয় সুনিয়ান দিবস। এই দিন মন্দিরের চাকর, সেবায়েত এবং মন্দিরের জমি গ্রাহকেরা লিঙ্গরাজের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা নিবেদন করে থাকেন।

লিঙ্গরাজ মন্দির সম্পর্কে বঙ্গদর্শনপত্রিকায়  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্য :

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিঙ্গরাজ মন্দির সম্পর্কে বলেছিলেন – “দেবতা দূরে নাই, তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন। তিনি জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, মিলন-বিচ্ছেদের মাঝখানে স্তব্ধভাবে বিরাজমান। এই সংসারই তাঁর চিরন্তন মন্দির। এই সজীব-সচেতন বিপুল দেবালয় অহরহঃ বিচিত্র হইয়া রচিত হইয়া উঠিতেছে। ইহা কোনকালে নূতন নহে, কোন কালে পুরাতন হয় না। কারণ এই চঞ্চল বিচিত্রের মধ্যে এক নিত্য সত্য প্রকাশ পাইতেছে।

মন্দিরের সময় :

মন্দির পরিচালনা পরিষদ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুসারে জানা যায়, লিঙ্গরাজ মন্দির সকাল ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে ভোগ প্রদানের সময়ে বন্ধ থাকে। ভোরবেলা লিঙ্গরাজের ঘুম ভাঙাতে তাঁর গর্ভগৃহে বাতি জ্বালানো হয়। স্নান করানো হয় এবং মঙ্গল আরতি করা হয়। দুপুর বারোটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মন্দির বন্ধ থাকে। দরজা বন্ধ হওয়ার পরে পঞ্চামৃত তথা দুধ, দধি, ঘি, মধু, ও মিছরি মিশিয়ে দেবতাকে মহাস্নান করানো হয়।

কিভাবে যাবেন লিঙ্গরাজ মন্দির ?

ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর থেকে মাত্র 4 কিমি দূরে অবস্থিত লিঙ্গরাজ মন্দির। এই মন্দিরে যাওয়ার জন্য আপনি রেল, বিমান বা রাস্তা দিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন। পর্যটকরা বিমানবন্দর বা রেলস্টেশন থেকে লিঙ্গরাজ মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করতে পারেন।

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, লিঙ্গরাজ মন্দির ভারতীয় স্থাপত্য এবং ধর্মের একটি অমূল্য নিদর্শন। এর স্থাপত্যের জটিলতা, ইতিহাস এবং ধর্মীয় গুরুত্ব এটিকে অন্যান্য শিব মন্দির থেকে আলাদা করে তুলেছে। যদি আপনি ভারতের ধর্মীয় এবং স্থাপত্য কলা  সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে লিঙ্গরাজ মন্দির অবশ্যই আপনার দেখার তালিকায় থাকা উচিত।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

রেলওয়ে ট্র্যাকে LPG সিলিন্ডার, কানপুরে ভয়ানক ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্যে রক্ষা

স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য! ৩২ বছর পর ভিটের টানে ফিরে এল এক বৃদ্ধ

চিকিৎসকদের মঙ্গলবার ৫ টার মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ প্রধান বিচারপতির

ভুলবশতঃ মেইতি এলাকায় ঢুকে পড়ায় কুকি ব্যক্তিকে পিটিয়ে খুন

চিকিৎসকদের মঙ্গলবার ৫ টার মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ প্রধান বিচারপতির

 ফের লখনউ, মোমো খেতে বেরিয়ে গণধর্ষণের শিকার নাবালিকা

Advertisement

এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ

দার্জিলিং

কালিম্পং

জলপাইগুড়ি

আলিপুরদুয়ার

কোচবিহার

উত্তর দিনাজপুর

দক্ষিণ দিনাজপুর

মালদা

মুর্শিদাবাদ

নদিয়া

পূর্ব বর্ধমান

বীরভূম

পশ্চিম বর্ধমান

বাঁকুড়া

পুরুলিয়া

ঝাড়গ্রাম

পশ্চিম মেদিনীপুর

হুগলি

উত্তর চব্বিশ পরগনা

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

হাওড়া

পূর্ব মেদিনীপুর