নিজস্ব প্রতিনিধি, হুগলি: শেরশাহের তৈরি জিটি রোড আগে ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতি। কথিত আছে, সেই রোড সোজা করেছিলেন ব্রিটিশ আমলের নামকরা ঠিকাদার নরেন্দ্রনাথ নন্দী। হুগলির চকবাজারের বাড়িতে পরে তিনিই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন। শুরুতে পুজো দেখতে যেমন ইংরেজরা আসতেন, তেমনই ঢল নামত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষের। সময়ের পরিবর্তনে এখন আর ইংরেজদের দেখা যায় না। তবে পার্শ্ববর্তী ইমামবড়া এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন এখনও পুজো দেখতে ভিড় করেন নন্দীবাড়িতে।
জিটি রোড সোজা করে দেওয়ার পর নরেন্দ্রনাথ নন্দীর কাজে খুশি হয়ে একের পর এক বরাত দেওয়া শুরু করে ব্রিটিশরা। সেই সূত্রে নন্দীবাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়েছিল সাহেবদের। পরিবারের সদস্যরা জানান, বড়দিনে সাহেবরা দামি সুরা, কেক ইত্যাদি উপহার নিয়ে আসতেন। তাদের জন্য বিশেষ টেবিল-চেয়ার আনানো হয়েছিল সেসময়, যা আজও আছে। পর পর কাজের বরাত পাওয়ায় বাড়িতেই প্রথম অন্নপূর্ণা পুজো শুরু করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। কথিত আছে, অন্নপূর্ণা পুজো করেই তাঁর সম্পত্তি আরও বেশ কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিল। অন্নপূর্ণার স্থায়ী মূর্তি তৈরি করে আনা হয়েছিল কুমোরটুলি থেকে। ওই সময়েই তৈরি করা হয়েছিল নাটমন্দির। অন্নপূর্ণার পাশাপাশি এই মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ ও হরপার্বতীর নিত্যপুজো চলে আসছে এখনও।
নরেন্দ্রনাথ নন্দীর হাত ধরেই ১৯২৫ সালে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল নন্দীবাড়িতে। আর পাঁচটা বনেদিবাড়ির মতোই এই বাড়ির পুজোতেও রয়েছে বিশেষ কিছু রীতি। মহালয়ার পরদিন প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে যায় পুজো। টানা ৯ দিন ধরে চলে চণ্ডীপাঠ। বছরের পর বছর ধরে একই কাঠামোয় একচালার প্রতিমা পূজিত হয় এখানে। আগে জন্মাষ্টমীর দিন হত কাঠামো পুজো। এখন রথযাত্রা থেকে উল্টোরথের মধ্যে যে কোনও একটা শুভদিন দেখে হয় কাঠামো পুজো। তারপর শুরু হয় প্রতিমা তৈরি। কুমোরটুলি থেকে আসে প্রতিমার সাজ। আগে সপ্তমীর দিন দরিদ্রসেবা হত। কাপড়, মিষ্টি, টাকা দেওয়া হত। বছরদশেক ধরে তা বন্ধ। পরিবর্তে হাসপাতাল, অনাথাশ্রম, স্কুলে সাহায্য করা হয়। অষ্টমীতে কুমারী পুজো, সন্ধিপুজোয় আখ, ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়ার চল এখনও রয়েছে। দশমীর দিন কাঁধে করে এলাকা ঘুরিয়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদনীঘাটে। পুজোয় যত ফুল লাগে সবই নন্দীবাড়ির নিজস্ব বাগান থেকেই তোলা হয়। বর্তমানে নরেন্দ্রনাথ নন্দীর তৃতীয় প্রজন্ম এই পুজোর দায়িত্ব বহন করছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, কাজী নজরুল ইসলাম হুগলি জেলে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর তিনি নন্দীবাড়িতে ছিলেন বেশ কিছুদিন। এখনও তাঁর স্মৃতি বয়ে চলেছে নন্দীবাড়ি। চকবাজারের ইমামবড়া অঞ্চলে অনেক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তাঁরাও বংশ পরম্পরায় নন্দীবাড়ির পুজো দেখতে আসেন। আজও সেই চল রয়েছে বলেই জানালেন বাড়ির সদস্যরা।