নিজস্ব প্রতিনিধি: চিল্কিগড়ের কনক দুর্গা মন্দির, ঝাড়গ্রাম তথা বঙ্গ পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম একটি নাম। এই মন্দিরের ইতিহাস ৫০০ বছরের পুরোনো। স্থানীয়দের কাছে খুবই জাগ্রত মন্দির। সারাবছরই এখানে বহু মানুষ আসেন পুজো দিতে। তবে দুর্গাপুজোর কয়েকটা দিন এখানে ভিড় করেন আশেপাশের জেলা এমনকি কলকাতার দর্শনার্থীরাও। এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব আজ খুঁজতে গেলে মনে কষ্টই লাগবে। তবে পাশেই নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে, সেখানেই এখন দেবীর অধীষ্ঠান। তবে বাংলার প্রাচীন এই মন্দির ঘিরে আজও রয়েছে বহু কিংবদন্তী ও ঐতিহাসিক গল্প। জনশ্রুতি এই মন্দিরে আজও অষ্টমীর রাতে নিজেই নিজের ভোগ রান্না করেন দেবী।
লোকশ্রুতি আছে প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দির। একসময় নরবলি হতো। তবে এখনও মোষ বা পাঁঠা বলি হয় এক বিশেষ রীতি মেনে। পুজোর চারদিন কনকদুর্গাকে হাঁসের ডিম, মাছ পোড়া, শাক ভাজা, পান্তা ভাত দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। অষ্টমির রাতে মন্দিরে পাতকুয়োর সামনে রেখে একটি পাঠা বলি নিবেদন করা হয় আজও। নিশি রাতে সেই বলি হয়৷ নবমীর অন্নভোগের আগে সেই বলির মাংস নতুন মাটির হাড়িতে সেদ্ধ করে রাজবাড়ির বিরাম কক্ষে রাখা হয়।
নবমী তিথির যজ্ঞের পরে সেই হাড়িতে রাখা বলির মাংস রান্না করে মায়ের ভোগ দেওয়া হয়। মন্দিরের পুরোহিতের কথায়, একেই বিরাম ভোগ বলা হয়। অষ্টমী বিহীত পুজোর পরই নিশি রাতে বলির আয়োজন হয় জঙ্গলের গভীরে। সেখানে তিথি-নক্ষত্র মেনে বলি হওয়ার পর সেটি নিয়ে আসা হয় রাজবাড়ির বিশেষ কক্ষে। এই বিরাম পুজোতে বাইরের কোনও মানুষ থাকে না। শুধুমাত্র পুরোহিত এবং কয়েকজন চর্চক উপস্থিত থাকেন যারা বলিতে অংশ নেন বংশ পরম্পরায়। দশমীর ভোগে কনকদূর্গাকে দেওয়া হয় পান্তা ভাতের সাথে শাক ভাজা।
ইতিহাসবিদ সুব্রত মুখোপাধ্য়ায় বললেন, প্রায় ৫০০ বছরেরও আগে চিল্কিগড়ে মত্তগজ রাজবংশের গোপীনাথ সিং এই পুজোর প্রতিষ্ঠা করেন। মত্তগজ বংশের পর চিল্কিগড়ের শাসনভার আসে ধবলদেও সিংহ বংশের হাতে। তাঁরও আগে ছিলেন ত্রিপাঠি বংশের রাজারা। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন শক্তির উপাসক। চিল্কিগড় এলাকাও তখন ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সুব্রতবাবু আরও জানিয়েছেন, চিল্কিগড়ের প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন মন্দিরটির পশ্চিমপ্রান্তে এক পরিত্যাক্ত দালানে একসময় নরবলি হতো। সেই বলি হতো অষ্টমী তিথিতে। সেই নররক্তেই পুজো হত কনকদূর্গার। তিনি জানান, ব্রিটিশ গবেষক হান্টারের লেখা স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল বইতে বাংলার কয়েকটি মন্দিরে নরবলির কথা উল্লেখ রয়েছে। তাতে চিল্কিগড়ের কনকদূর্গা মন্দিরের কথাও রয়েছে। সেই প্রথা আজও চলছে, তবে এখন নরবলি নয়, প্রাচীন প্রথা মেনে মোষ বলি হয় এখানে।
চিল্কিগড়ের কনকদূর্গা পুজোয় বেশ কয়েকরকমের ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমী তিথিতে হাসের ডিমের পদ ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। তাকে বলে গঞ্জভোগ। তবে এখানে সন্ধিপুজোর বিশেষ গুরুত্ব আছে। ওই দিনই মা কনকদুর্গাকে দেওয়া হয় বিরাম ভোগ। যা মায়ের বিশেষ রান্না। চিল্কিগড়ের রাজবাড়িতে আছে বিশেষ বিরাম কক্ষ। সেখানেই নতুন মাটির হাড়িতে জল ও অন্য়ান্য সামগ্রী দিয়ে শালপাতা দিয়ে ওই হাড়ির মুখ বেধে উনোনে চাপানো হয়। ওই উনোনে তিনটি কাঠে আগুন জ্বেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে তালাচাবি বন্ধ করা হয়। এরপর গভীর জঙ্গলে হয় পাঁঠা বা মোষ বলি। পরে নির্দিষ্ট সময়ে সেই বলির মাংস পরিস্কার করে ওই হাড়িতেই রান্না করা হয়। পরে সন্ধিপুজোর যজ্ঞে সেই ভোগ নিবেদন করা হয় কনকদুর্গাকে। আজও চলে আসছে সেই রীতি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, দেবী সয়ং এই ভোগ রান্না করেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ঝাড়গ্রাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ডুলুং নদীর তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কনক দুর্গা মন্দির। দেবী এখানে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা। অষ্টধাতুর এই মূর্তি ঘিরেই জমে ওঠে দুর্গাপুজো। তবে মাও আমলে ২০০৭-২০০৮ সালে দু’বার চুরি গিয়েছিল কনক দুর্গার মূর্তি। প্রতিবারই নতুন করে তৈরি হয়েছে অষ্টধাতুর মূর্তি। যদিও এখন মন্দির চত্বরে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। মন্দির লাগোয়া এলাকায় বিশাল ভেষজের জঙ্গল। বর্তমান তৃণমূল সরকার এই চত্বরে পর্যটনের সম্ভবনা বৃদ্ধিতে সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি পরিকাঠামো উন্নতি করেছে। মন্দির ও গাছের রক্ষণাবেক্ষণে রাখা হয়েছে নিপত্তারক্ষী। তৈরি হয়েছে চেকপোস্টও।