নিজস্ব প্রতিনিধি: শরীর এবং মন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শরীর যেমন অসুস্থ হয়, মন ও তেমন অসুস্থ হয়। শরীর খারাপ হলে তার প্রভাব যেমন মনের ওপর পড়ে, তেমন মন অসুস্থ হলেও তার প্রভাব শরীরের ওপরে পড়ে। শরীরকে আমরা চোখে দেখতে পাই। তাই এর অসুস্থতাকে আমরা গুরুত্ব দেই। কিন্তু মনকে যেহেতু চোখে দেখি না, তাই মনের অসুস্থতাকে আমরা চটকরে গুরুত্ব দিতে চাইনা। অদ্ভুতভাবে মনের এই অসুস্থতা অনেক সময় শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। তখন আমরা, যেহেতু শরীর খারাপ তাই, তার প্রতি মনোযোগ দিতে বাধ্য হই।
কিভাবে বুঝবেন
আপনি গত এক সপ্তাহ ধরে অত্যধিক উদ্বেগে ভুগছেন। হঠাৎ করে দেখলেন যে আপনার পিঠ, পেট ও হাত পায়ে ব্যথা শুরু হলো, অথবা তীব্র মাথা যন্ত্রণা শুরু হল। আবার আপনি অলস ও ক্লান্ত বোধ করতে পারেন।
পিএইচডি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং লেখক কারলা ম্যানলে -এর মতে, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পেশী টান, ব্যথা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা এবং অস্থিরতার মতো শারীরিক উপসর্গের অভিজ্ঞতা পেতে পারেন।তারা ” মস্তিষ্কের কুয়াশা ” অনুভব করতে পারেন, যেখানে আপনি মনে করবেন আপনার মস্তিষ্ক অস্পষ্ট এবং অচল এবং আপনি মনোনিবেশ করতে বা তথ্য মনে রাখতে পারছেন না। উদ্বেগ পেটের ব্যথার কারণও হতে পারে । মেলিসা জোন্স , পিএইচডি, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট বলেছেন, উদ্বেগের ফলে ডায়রিয়াও হতে পারে। জোন্স বলেন, অনেক সময় নার্ভাস বা নতুন কিছু করার চেষ্টা করলে অনেকের পেট খারাপ হয়ে যায়। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিদের ডায়রিয়া বা মাইগ্রেন বৃদ্ধি পায় যখন তাদের উদ্বেগ এবং চাপ বেড়ে যায়।
যখন শারীরিক লক্ষণগুলি আপনার মানসিক অবস্থার কারণে বা খারাপ হয়ে যায়, তখন তাকে বলা হয় সাইকোসোমেটিক।
উদ্বেগের ক্ষেত্রে শারীরিক লক্ষণ গুলি হল,
মাথাব্যথা
পেশী টান এবং ব্যথা
হজমের সমস্যা যেমন ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, এবং খিদে পরিবর্তন
ঘুমের সমস্যা বা ব্যাধি
অলসতার অনুভূতি
হতাশার ও কয়েকটি শারীরিক লক্ষণও রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে:
ব্যথা
হজমের সমস্যা
ক্লান্তি
মাথাব্যথা
চোখের সমস্যা
স্ট্রেস এবং ট্রমা অটোইমিউন ডিসঅর্ডার যেমন হাশিমোটোর থাইরয়েডাইটিস, সোরিয়াসিস, রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি।
কেন হয়?
মানসিক অসুস্থতা আপনার মস্তিষ্ক কে প্রভাবিত করে। যেহেতু মস্তিষ্ক আপনার শরীরের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কে প্রভাবিত করে, তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, যে মানসিক অসুস্থতায় শারীরিক উপসর্গ দেখা দেবে।
যখন আমরা সামনে বিপদ দেখি, তখন আমাদের শরীর দু’রকমের প্রতিক্রিয়া করতে পারে। বিপদের মোকাবিলা করার জন্য শরীর প্রস্তুত হতে পারে, যাকে বলে ‘ফাইট রেসপন্স’ এবং পালিয়ে যেতে পারে যাকে বলে ‘ফ্লাইট রেসপন্স’। এইসময় আমাদের শরীর দুটি স্ট্রেস হরমোনে ভরে যায়। অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসল। এটি হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, পাচনতন্ত্রের কাজ কমিয়ে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।এটি আমাদের প্রচুর শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করতে সাহায্য করে যা আমাদের বিপদের সময় প্রয়োজন হয়। বিপদ চলে যাওয়ার পরে, আমাদের দেহ সাধারণত বিশ্রামের অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগের মধ্যে থাকেন, তাহলে কর্টিসল এবং অ্যাড্রিনালিন হরমোন দুটি বেশি পরিমাণে ক্ষরিত হতে থাকবে। শরীর বিশ্রাম অবস্থায় ফিরতে পারবে না। ফলে এটি আমাদের শারীরিক ক্রিয়া-কলাপ কে প্রভাবিত করবে।
মস্তিষ্কের যে অংশগুলি উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার সাথে যুক্ত, সেই অংশগুলি শারীরিক ব্যথার উদ্দীপনা গ্রহণের সাথেও যুক্ত এবং মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের ব্যথার সংকেতের জন্য দায়ী যে দুটি নিউরোট্রান্সমিটার ( সেরোটোনিন এবং নোরপাইনফ্রাইন )তারাও উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার সাথে জড়িত। ফলে মানসিক অসুস্থতায় শরীরও প্রভাবিত হয়।
কি করবেন
১) উদ্বেগের ফলে যে হরমোন গুলি ক্ষরিত হতে থাকে, সেগুলিকে বিভিন্ন কাজে ব্যয় করা অর্থাৎ প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করা, দৌড়ানো বা হাঁটা ইত্যাদি খুব ভালো কাজ দেয়।
২) মানসিক চাপ মোকাবিলা করার আরেকটি উপায় হল শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম। খুব গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া এবং ধীরে ধীরে প্রশ্বাস ছেড়ে দেওয়া। এটি আপনাকে শান্ত হতে সাহায্য করবে।
৩) যে কারণে হতাশা বা উদ্বেগ হচ্ছে সেই কারণ গুলি কে চিহ্নিত করা। যে নেতিবাচক চিন্তা গুলি মনের মধ্যে বারবার আসছে সেগুলিকে লিখে ফেলা এবং সেগুলির বিপরীত একটি করে ইতিবাচক চিন্তা ভাবা। যেমন চিন্তাটি যদি হয়, ‘এই কাজটি কি আমি বর্তমানে করে উঠতে পারব? গতবার এই কাজটি করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম।’ তাহলে এর বিপরীতে ইতিবাচক চিন্তা হতে পারে, ‘এবারে, আমার কর্মপদ্ধতি আরও পরিষ্কারভাবে জানা আছে, এখন আমার অভিজ্ঞতা আরও বেশি। সুতরাং আমি সফল হতে পারি।’
৪) যা হয়ে গেছে তা আমাদের হাতে নেই এবং যা ঘটতে চলেছে তার উপরেও আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং এই মুহূর্তে মনোনিবেশ করতে হবে। যত আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাববো তত উদ্বেগ বেশি হবে।
৫) শারীরিক উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমে আমাদের জেনারেল ফিজিশিয়ান কে দেখাতে হবে। উনারা বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন যে এই উপসর্গগুলোর পেছনে কোনো শারীরিক কারন আছে কিনা। যদি রিপোর্টে দেখা যায় শারীরিক কারন ছাড়াই উপসর্গগুলি হচ্ছে, তখন প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে।
লেখক : পুষ্পিতা মুখার্জি (মনোবিদ ও শিক্ষিকা)