নিজস্ব প্রতিনিধি: ‘কলামন্দির’-এর উদ্যোগে ব্যারাকপুরের বুকে আজ এক টুকরো শান্তিনিকেতনী মেজাজ। আকাশ-বাতাস প্রকৃতি বলছে এসেছে বসন্তকাল, কিন্তু বসন্তের সেই প্রাকৃতিক উন্মাদনা কোথায়! চাঁদিফাটা গরমে প্রকৃতিও যেন শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাঙালি আছে আপন ছন্দে! কারণটা তো স্পষ্টই।
বাঙালি মানে ঘটি এবং বাঙালদের খুনসুঁটি, বাঙালি মানে বারো মাসে তেরো পার্বণ, বাঙালি মানে দোলপূর্ণিমার হাত ধরে প্রকৃত বসন্তকালে প্রবেশ, আর বসন্তের শেষ আর বাঙালির নববর্ষের শুরু! এই নিয়ে গোটা বছরটা বাঙালির বেশ আমোদ-প্রমোদে কেটে যায়। বছরের শেষে তো আছেই শারদোৎসব। এদিকে আবার আসছে লোকসভা নির্বাচন, চারিদিকে ভোটপর্বের মহাসমারোহ চলছে। তার মধ্যে চাঁদিফাটা গরম! তবে এর মধ্যেই বাঙালি ঠিক খুঁজে নেয় প্রাণখোলা আনন্দ, মজা করার সুযোগ। যাই হোক, গত ২৫ মার্চ গিয়েছে দোলপূর্ণিমা। ওদিন ছোট থেকে বড় মোটামুটি সবাই মেতে উঠেছিল রঙের খেলায়। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিল, যাঁরা রং গায়ে লাগার ভয়ে দরজায় খিল দিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু বছরে একটা দিন রঙের উৎসব, তা কি আর বাড়িতে দরজা বন্ধ করে থাকা যায়!
যাই হোক, রঙের উৎসব বাঙালির সংস্কৃতিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তাই শুধু রং খেলে নয়, এই উৎসব নানাভাবে পালন করেন বাঙালি জাতি! যাতে সারাজীবন স্মৃতির গোড়ায় লেগে থাকে এই উৎসবের রং। এদিন সকাল থেকে প্রভাত ফেরি করেন অনেক সাংস্কৃতিক সংস্থা গুলি। আবার পাড়ার ক্লাব থেকেও নানারকম আয়োজন করা হয়। কিন্তু কিন্তু, এ বছর ব্যারাকপুর ‘কলামন্দির'(Kalamandir) -এর বসন্ত উৎসবটা মনে হয়, গোটা সপ্তাহ ধরেই চলল। আর সবটা কৃতিত্ব যায় একজনের উপরেই, তিনি হলেন শ্রী গৌতম দে মহাশয়। তাঁর নৃত্য প্রতিষ্ঠানের একগুচ্ছ নিবেদনের সাক্ষী থাকলেন উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের বাসিন্দারা। ব্যারাকপুর অতি প্রাচীন একটি নৃত্য কলাকেন্দ্র হল ‘কলামন্দির’!
যেখানে প্রায় ৫০০ টির বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে সুন্দর সংসার এই নৃত্য প্রতিষ্ঠানের গুরু গৌতম দে মহাশয়ের। কচিকাচাদের থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সকলেই তাঁর ছাত্র-ছাত্রী। কোনও বয়সসীমা বেঁধে দেননি তিনি, যে কোনও বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যেই তাঁর দ্বার সবসময় খোলা। আসলে শিল্পের একটি উত্তেজিত আঙিনা হল নৃত্য। এবার আসি আসল কথায়, ২৫ মার্চ থেকেই ‘কলামন্দির’ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। তবে তার শেষটা হল আজ শুক্রবার ২৯ মার্চ। বসন্তের ডালি দিয়ে সেজেছিল ব্যারাকপুর সুকান্ত সদন। শ্রী গৌতম দে মহাশয়ের নেতৃত্বে শুক্রবার বিকেল ৫ টা থেকে শুরু হয় তাঁর নৃত্য প্রতিষ্ঠানের বসন্ত উৎসবের প্রাক-পর্ব। প্রথমে ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড় থেকে থেকে শুরু হয় এই অনুষ্ঠানের rally। এখানে যোগদান করেন ছাত্রীদের পাশাপাশি তাঁদের বাবা-মায়েরাও। সকলেই হলুদ বর্ণের শাড়িতে সেজেছিলেন। আর মূলপর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যে ৬ টা থেকে। অনুষ্ঠানের শিরোনামে ছিল, ‘আজই বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’!
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্যায়ের ভাবনা ছিল শান্তিনিকেতনী ঢঙে রবীন্দ্র নৃত্য এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল মাটির গান অর্থাৎ লোকসঙ্গীতের তালে নৃত্য। প্রায় ১ মাসে ধরে চলেছে এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্ব। এদিন জমকালো সাজে দেখা মিলেছে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীদের। কচিকাচা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েরা ছিল এই জমকালো অনুষ্ঠানের পারফর্মার। শুধু তাই নয়, ছাত্রীদের উৎসাহ দিতে নৃত্যগুরু গৌতম দেরও ছিল বিশেষ নিবেদন। এছাড়াও অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন ছাত্রীদের মায়েদের নৃত্য পরিবেশন। সব মিলিয়ে ব্যারাকপুর যে আজ এক টুকরো শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল তা বলাই বাহুল্য! আর এই অনুষ্ঠান দেখতে সুকান্ত সদনে ভিড় জমিয়েছিলেন অগন্তি দর্শক, rally-তেও অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। সুন্দর সুন্দর নৃত্য পরিবেশনে জমে গেল গোটা অনুষ্ঠানটা।
শুধু তাই নয়, নৃত্যগুরুর মেয়ে দেবকন্যা দেও অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করে মন জয় করলেন সবার। সুতরাং গৌতম দে-মহাশয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ যে সবকিছুর উর্ধে উঠে গেল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা ছিলেন নৃত্যগুরুর স্ত্রী শ্রীমতী ঝুমকি দে মহাশয়া। আশা করি, আগামী দিনগুলিও গৌতম দে মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় ‘কলামন্দির’ আরও সুন্দর সুন্দর উপহার ব্যারাকপুরবাসীদের দেবে।