নিজস্ব প্রতিনিধি : শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে সনাতন ধর্মকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার পর সারা বিশ্ব জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেইসময় তাঁর খ্যাতি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি অবিভক্ত বাংলাতেও স্বামীজিকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। স্বামীজির খ্যাতি এমন একটা জায়গা গিয়ে পৌঁছোয় যে তা পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশের ছাত্র সমাজকেও আলোড়িত করেছিল।
১৯০১ সালে ১৮ মার্চ নয় জন সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে স্বামীজিরা পৌঁছোন গোয়ালন্দে। ১৯ মার্চ গোয়ালন্দ থেকে ছাড়ে স্টিমার। স্বামীজির স্টিমার ওইদিনই নারায়ণগঞ্জে গিয়ে পৌঁছোয়। নারায়ণগঞ্জে স্বামীজী ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের অভ্যর্থনা জানান ঢাকা থেকে আগত ‘ঢাকা অভ্যর্থনা সমিতি’। সেখান থেকে সমিতির সদস্যরা স্বামীজিকে ট্রেনে করে ঢাকায় নিয়ে যায়। স্বামীজি যখন ঢাকায় পৌঁছোন, তখন তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য ঢাকা স্টেশনে অপেক্ষারত ছিলেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। সেদিন ঢাকার নগরবাসীর পক্ষ থেকে স্বামীজিকে অভ্যর্থনা দিয়েছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও গণেশচন্দ্র ঘোষ। তাঁরা এই বীর সন্ন্যাসীকে নিয়ে যান ফরাশগঞ্জের জমিদার মোহিনী মোহন দাসের বাড়িতে। জানা যায়, স্বামীজিকে যখন জমিদার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সেখানকার যুব সমাজ ‘জয় রামকৃষ্ণ কী জয়’ ধ্বনি দিয়েছিলেন। স্বামীজিকে ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
এরপর সেই বছর ৩০ ও ৩১ মার্চ ঢাকায় দুটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। প্রথমদিন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ইংরাজি ভাষায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। সেই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী রমাকান্ত নন্দী। প্রায় দু হাজার লোকের সামনে এক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল, তিনি কী শিখেছেন। এরপরদিন ঢাকার পোগোজ স্কুলে খোলা ময়দানে দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন স্বামীজি। প্রায় তিন হাজার লোক স্বামীজির ওই বক্তৃতা শুনেছিল। সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা স্বামীজির সেই বক্তৃতা শুনেছিলেন।
শুধু ঢাকাতেই নয়, সেবার মা, মাসি ও বোনকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পুণ্যস্তান করতে লাঙ্গালবন্দেও পৌঁছোন স্বামীজি। ১৯০১ সালের ২৯ মার্চ লাঙ্গালবন্দে পুণ্যস্নান করতে গিয়েছিলেন এই বীর সন্ন্যাসী। কথিত আছে, ব্রহ্মপুত্র তীরে এই পুণ্যস্নানে করে পরশুরাম মাতৃহত্যাজনিত পাপ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই এই স্নানটি পূণ্যক্ষেত্র হিসাবে প্রচলিত হয়ে আসছে। জানা যায়, স্বামীজি যখন এই পুণ্যস্নান করতে গিয়েছিলেন, সেদিনও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছিল। সারিবদ্ধ নৌকা থেকে স্বামীজিকে উদ্দেশ্য করে হরিনাম সংকীর্তন ও উলুধ্বনিও দেওয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয়, স্বামীজি এই ঢাকাতে বসেই নিজের মৃত্যু সম্পর্কে শিষ্যদের অবগত করেছিলেন। শিষ্যদের কাছে এক বক্তৃতায় স্বামীজি জানিয়েছিলেন, তিনি হয়ত আর বরজোর এক বছর আছেন। মা যেসব জায়গায় তীর্থ করতে যেতে চান, সেখানে তাঁকে নিয়ে যাওয়াই তাঁর কর্তব্য। এরপর মা ভুবনেশ্বরী দেবীকে নিয়ে কামাখ্যায় গিয়েছিলেন স্বামীজি। এক বছর পর ১৯০২ সালে ৪ জুলাই প্রয়াত হয়েছিলেন এই বীর সন্ন্যাসী।