নিজস্ব প্রতিনিধি: উনিশ আর একুশের ভোটে যারা দুইহাত ঢেলে ভোট দিয়েছে তাঁরাই চূড়ান্ত ভাবে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন। শিলিগুড়ি পুরনিগমের পরে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদেও(SMP)। দুটি ক্ষেত্রেই গেরুয়া শিবিরের আশা ছিল তাঁরাই বোর্ড দখল করবেন। বিগত উনিশ ও একুশের ভোটের সংখ্যাতত্ত্বও কার্যত বলে দিচ্ছিল গেরুয়া শিবিরের সেই আশা ভুল নয়। কিন্তু জনতা চললেন ভিন্ন পথে। তাঁরা শিলিগুড়ি পুরনিগমের পরে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ক্ষেত্রেও বেছে নিলেন রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকেই(TMC)। বাম ভোট রামে যাওয়ার প্রবণতা বজায় থাকায় ৩২ বছরের বাম দুর্গ গুঁড়িয়ে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদে উড়ল জোড়াফুলের পতাকা। আর সেটা কার্যত চেয়ে চেয়ে দেখলেন গেরুয়া শিবিরের নেতা থেকে কর্মী। আর সেই সঙ্গে তাঁরা এটা মেনেও নিলেন ২৪’র বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কেউ ঠেকাতে পারবেন না। কারণ মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ৯টি আসনের মধ্যে ৮টি গিয়েছে তৃণমূলের ঝুলিতে। মাত্র ১টি পেয়েছে বিজেপি(BJP)। পরিষদের এলাকায় থাকা ৪টি ব্লকের ৪টি পঞ্চায়েত সমিতিও তৃণমূলের দখলে গিয়েছে। ৪টি ব্লকের মোট ৬৬টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের দখলে গিয়েছে ৫৫টি আসন। বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৮টি। নির্দলরা পেয়েছে ২টি আসন। ৪টি ব্লকের ২২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত চলে এসেছে তৃণমূলের দখলে। ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ত্রিশঙ্কু ফলাফল এলেও সেখানে পাল্লা ভারী তৃণমূলেরই। তাই সেই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতও তৃণমূলের দখলে এলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের ৪৬২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল দখল করেছে ৩২০টি। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ৮৬টি আসন মাত্র। কার্যত এই ফলই বলে দিচ্ছে শিলিগুড়ি মহকুমার মানুষ আর বিজেপিকে চাইছেন না। তাঁদের আস্থা এখন রাজ্যের শাসক দলের ওপরেই। কিন্তু কেন?
বিক্ষুব্ধ বিজেপি শিবিরের অভিমত, বিজেপির নেতা থেকে বিধায়ক সাংসদ যেভাবে বার বার বাংলা ভাগের দাবি তুলছেন তাতে করে বহু গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গের(North Bengal) মানুষজন রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়ন চান। রাজ্যভাগে তাঁদের তীব্র আপত্তি রয়েছে। তাঁদের সেই অভিমতই তাঁরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া মানুষের আস্থা জিতেছে রাজ্যের শাসক দল। কোভিড কালে রাজ্য সরকারের আর্থসামাজিক প্রকল্পের উপকারিতা মানুষজন পেয়েছেন। আগামি দিনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, জয় জোহর, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, কৃষকবন্ধু, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের টাকাও যে ঠিকঠাক ভাবে প্রতি বছর, প্রতি মাসে তাঁরা পাবেন সেই বিশ্বাস শাসক দলের ওপর রেখেছেন আমজনতা। বিজেপি শুধু ভোটে লড়ছে। মানুষের পাশে থেকে মানুষের আস্থা জয়ের কোনও চেষ্টাই তাঁরা করেনি। তবে সব থেকে বেশি ব্যুমেরাং হয়েছে উত্তরবঙ্গ ভাগের দাবি।
কেননা বিজেপির নেতারা কখনও দাবি তুলছেন পাহাড়ে আলাদা রাজ্য হবে। কখনও বলছেন আলাদা কোচ রাজ্য হবে। কখনও কেএলও জঙ্গি জীবন সিংহের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। পৃথক কামতাপুর রাজ্য গঠনের দাবি তুলছে। এই সব জিনিস দেখে মানুষজন রীতিমত আতঙ্কিত। উত্তরবঙ্গকে এভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো করার ষড়যন্ত্র তাঁরা মেনে নেননি। বিজেপির পাতা ফাঁদে পাও দেননি। শান্তি, স্থিতি আর উন্নয়নের জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছেন তৃণমূলকেই। বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলা ভাগের দাবি ও ষড়যন্ত্র তাঁরা মেনে নেবেন না। আর আমজনতার সেই মনোভাবের আঁচ করেই বিজেপির নেতা থেকে কর্মী সবাই একবাক্যে মানছেন ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে(Election) বাংলার বুকে বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। মোদি-শাহ-নাড্ডা-শুভেন্দু-সুকান্ত-দিলীপ কেউ পারবেন না বিপর্যয় ঠেকাতে।
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ২২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে যে ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতে ফলাফল ত্রিশঙ্কু হয়েছে সেখানেও বোর্ড গঠনের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। মাটিগাড়া ব্লকের পাথরঘাটা এবং ফাঁসিদেওয়া ব্লকের জালাস-নিজামতারা ও চটহাট গ্রাম পঞ্চায়েত তিনটির ফলাফল ত্রিশঙ্কু হয়েছে। পাথরঘাটা পঞ্চায়েতের মোট আসন সংখ্যা ২৮টি। এরমধ্যে তৃণমূল ১৪টি, বিজেপি ৯’টি, বামফ্রন্ট ৩টি, নির্দল ও কংগ্রেস ১টি করে আসন পেয়েছে। এখানে নির্দলের সমর্থনেই বোর্ড গড়তে চলেছে জোড়াফুল। আবার জালাস-নিজামতারায় ২২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ১১টি, বিজেপি ১০টি এবং নির্দল ১টি আসন পেয়েছে। এখানেও নির্দলের সমর্থনে বোর্ড গড়তে চলেছে তৃণমূল। চটহাটে ১৮টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৯’টি, নির্দল ৮টি এবং বিজেপি ১টি আসন পেয়েছে। এখানেও ২জন নির্দল প্রার্থীর সমর্থনে বোর্ড গড়তে চলেছে জোড়াফুল। বিজেপির চেয়ে চেয়ে দেখা ভিন্ন আর কিছুই করার নেই। ২৪ এর বিপর্যয়ও তাঁদের চেয়ে চেয়েই দেখতে হবে।