নিজস্ব প্রতিনিধি: কোভিড আবহে রাজ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা যে বেড়েছে সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। নানা পরিসংখ্যান সেই তথ্য তুলে ধরছে। কিন্তু এবার সমাজ বদলাবার পণ নিয়ে বাল্যবিবাহ রোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ‘গোলাপসুন্দরী’ সাজে রাস্তার মোড়ে নাচ দেখিয়ে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একজন প্রধান শিক্ষক(Head Sir)। তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসার পাশাপাশি তীব্র সমালোচনার ঢেউও বয়ে যাচ্ছে। এমনকি নানা মহলে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঢেউও উঠেছে। যাকে ঘিরে এই ঝড় তিনি হুগলি(Hooghly) জেলার আরামবাগ(Arambag) মহকুমার খানাকুল রাজা রামমোহন চক্রের অন্তর্গত মাজপুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়(Debasish Mukhopadhay)। ৫২ বছরের এই মানুষটির অভিনব এই উদ্যোগকে এলাকাবাসীও যে খুব একটা ভাল চোখে দেখছেন এমনটাও নয়। তাঁরা একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ‘নাচনি’(Nachni) সেজে ঘুরে বেড়াতে দেখতে চাইছেন না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে দেবাশিষবাবুর এই প্রচেষ্টা কী আদৌ সমাজের মনোভাবে বদল আনবে!
আরও পড়ুন কোভিড ধাক্কা কাটিয়ে ঝাড়গ্রামে বসছে হস্তশিল্পের সম্ভার
জানা গিয়েছে, স্কুলে ছুটির দিনে অন্যান্য শিক্ষকরা যখন পরিবারকে সময় দেন সেই সময় দেবাশিষবাবু সমাজের মানসিকতায় বদল আনার তাগিদে বাড়ি ছেড়ে বহুরূপী সেজে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ান। শুধু নিজের জেলাই নয়, গত একবছরে তিনি বাঁকুড়া, বর্ধমান, দুই মেদিনীপুর ছাড়িয়ে কলকাতাতেও পৌঁছে গিয়েছেন। এমনকি বাল্যবিবাহ রোধের বার্তা ভিন রাজ্যের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি একবার পুরীতেও ঘুরে আসেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনি নিজেকে ‘বহুরূপী’ হিসাবে তুলে ধরলেও আদতে এলেকার মানুষজন তাঁকে ‘নাচনী’ হিসাবে চিহ্নিত করছেন। আর শিক্ষকতার পেশা যেখানে এখনও মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন সেখানে দেবাশিষবাবুর এই নাচনী রূপ তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের দাবি, দেবাশিষবাবুর প্রচেষ্টাকে তাঁরা কুর্নিশ জানাচ্ছেন। তিনি এই কাজ করে চলুন, কিন্তু ‘নাচনী’ সাজে নয়। অন্য কিছু ভাবে। যদিও দেবাশিষবাবুর দাবি, তিনি এই বিষয়টি নিয়ে একদমই চিন্তিত নন। কেননা তাঁর দাবি মতো, যেখানেই তিনি যান না কেন স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে ভালো সাড়া পান। তাই নিজের সাজে তিনি বদল আনতে চান না।
আরও পড়ুন হাওড়া শাখায় কাজের জন্য বাতিল একাধিক ট্রেন, দেখে নিন তালিকা
হুগলি জেলার আরামবাগ থানার তিলকচক গ্রামে বাড়ি দেবাশিষবাবুর। বাড়িতে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী কাবেরি মুখোপাধ্যায়। তিনিও স্থানীয় একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। এছাড়াও রয়েছেন মা ও ১৯ বছরের ছেলে ও ১২ বছরের মেয়ে। ছেলে বি টেক ও মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। এরকম একটি পরিবারের কর্তা দেবাশিষবাবু ছুটির দিনে পরিবার ছেড়ে সমাজের জন্য মাইলের পর মাইল বহুরূপী সেজে ঘুরে বেড়ান। এই প্রসঙ্গে হুগলির রাজা রামমোহন চক্রের এসআই চন্দন বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘দেবাশিসবাবু অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতা করেন। এছাড়াও সমাজ সেবার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ছুটির দিনে সামাজিক নানা কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সম্প্রতি তিনি বাল্য বিবাহ রোধে সচেতনতামূলক কাজ করছেন বলে শুনেছি। তাঁর কাজের মধ্যে কোনও ভুল ত্রুটি হয়েছে বলে আমি মনে করি না।’
আরও পড়ুন কেষ্ট কন্যার অ্যাকাউন্টে পঞ্চম লটারির হদিশ পেল সিবিআই
কিন্তু হঠাৎ এই পদক্ষেপ কেন? এই বিষয়ে দেবাশিসবাবু জানিয়েছেন, ‘পেশায় আমি যাই হই না কেন, সমাজের কাছে আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। অনেক ছোট থেকেই সমাজের জন্য কিছু করার ভাবনা ছিল। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সমাজসেবার সঙ্গে যুক্তও হয়েছি। কিন্তু করোনা পর্বে বাল্যবিবাহ প্রচণ্ডরকম বেড়ে গিয়েছে দেখে তা নিয়ে সমাজের কাছে বার্তা পৌঁছানো প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছে। তবে সাধারণভাবে প্রচার করে খুব একটা সাড়া পাওয়া যাবে বলে আমার মনে সংশয় তৈরি হয়। সেজন্য মানুষের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য বহুরূপী ‘গোলাপসুন্দরী’র সাজে পথে নেমেছি। ওই কাজে পরিবারের সম্মতি পেয়েছি।’ আর এই গোলাপসুন্দরী’র সাজ নিয়েই আপত্তি গ্রাম্য সমাজের পাশাপাশি কিছু সরকারি মহল ও এলিট ক্লাসে। কেননা এই সাজের জন্য দেবাশিষবাবুকে পরতে হয় ঘাঘড়া ও টপ। কেন দুল, গলায় হাত, পায়ে ঘুঙুর। মাথায় থাকে লম্বা পরচুল। কপালে থাকে টিপ। মুখ সেজে ওঠে গোলাপি রঙে। আর এই সাজ পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার বিখাত ‘নাচনী’ পেশার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। আর এখানেই গ্রাম্য সমাজের পাশাপাশি এলিট সমাজের তীব্র আপত্তি। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে তাঁরা এই চেহারায় দেখতেই চাইছেন না।