নিজস্ব প্রতিনিধি: মুর্শিদাবাদ মানেই নবাবের শহর। শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য। হাজারদুয়ারী প্রাসাদ এরমধ্যে অন্যতম। প্রথম পর্বে আমরা শুধু এই হাজারদুয়ারী নিয়েই গল্প করলাম। আসুন দ্বিতীয় পর্বে আমরা বাকি অংশের দ্রষ্টব্যগুলি সম্পর্কে জানি।
কাটরা মসজিদ
কাটরা মসজিদ ভালোভাবে দেখতে হলে অবশ্যই একজন গাইড নেবেন। চার্জও বেশি নয়, মাত্র ৫০ টাকা। তিনি ভালো করে ঘুরিয়ে দেখাবেন এবং ইতিহাস নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করবেন। কাটরা মসজিদের পিছন দিয়ে দিক ঢুকতে হয় কারণ সেখান দিয়েই প্রধান রাস্তা। একসময় এই মসজিদ বেশ সমৃদ্ধ ছিল। এখানে বিশাল উপাসনা গৃহ ছাড়াও ছাত্রাবাস ছিল, যেখানে একসঙ্গে বহু আবাসিক একসঙ্গে থেকে পড়াশোনা করতে পারত। একসময় এই কাটরা মসজিদে একসঙ্গে ২০০০ মানুষ নমাজ পড়তে পারতেন।
এই মসজিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল এর প্রবেশপথের নীচেই রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র সমাধি। নবাব বলেছিলেন “এই মসজিদে যত মানুষ আসবেন তাঁদের পায়ের ধুলো আমার সমাধিতে পড়বে। তাতেই আমার পাপ ধুঁয়ে যাবে”। তবে ভূমিকম্প কাটরা মসজিদের অনেক কিছুর ক্ষতি হয়েছে। মসজিদের চারকোণে চারটে সুদৃশ্য মিনার ছিল যাদের মধ্যে দু’টো ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। একসময় সুন্দর কেয়ারি করা বাগান ছিল। কিন্তু করোনার সময় থেকে বন্ধ থাকার ফলে তা নষ্ট হয়েছে।
কাঠগোলা বাগানবাড়ি
এবার চলুন কাঠগোলা বাগানবাড়ি দেখতে। ১৯ শতকের শেষদিকে তৈরি এই বিলাসবহুল প্রাসাদটি মূলত বিদেশী উপকরণে ঠাসা। এটি দেখতে এবং ইতিহাস জানতে গাইড নিতে পারেন। মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। এটি আসলে দুগার পরিবারের বাড়ি। রাজস্থান নিবাসী এই দুগার পরিবার অত্যন্ত ধনী ছিলেন এবং এই বাড়িতে তাঁদের ব্যবহৃত সামগ্রী এবং আসবাবপত্র রয়েছে। আজও তাঁদের বংশধরেরা কলকাতায় থাকেন। সংগ্রহশালায় ঢুকতে হলে প্রবেশমূল্য ১৫ টাকা। অত্যন্ত সুদৃশ্য এই বাগানবাড়ি, বাগান এবং পুকুরটি ঘুরে দেখতে ভালোই লাগবে। এছাড়া একটি ছোট্ট পাখি ও মাছের চিড়িয়াখানা আছে। যা শিশুদের আনন্দ দেবে।
জগৎ শেঠের বাড়ি
ইতিহাস এখানে কথা বলে। জগৎ শেঠের বাড়ির প্রবেশমূল্য মাত্র ১৫ টাকা। এবং গাইড চার্জ ৫০ টাকা। অবশ্যই গাইড নেবেন। তাহলেই বুঝতে ও সমৃদ্ধ ইতিহাস জানতে পারেবন। ‘জগৎ শেঠ’ একটি পারিবারিক উপাধি। বিপুল ধনসম্পদ ও সেই সুবাদে প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগকারী এই পরিবারটির আবাস ছিল সেই সময়কার সুবা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে। নশিপুর এলাকায় তাঁদের বিশাল বাড়ি। কথিত আছে, মুর্শিদকুলি বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নিজামতি পদ লাভ করে মুর্শিদাবাদে টাঁকশাল স্থাপন করেছিলেন। সেই টাঁকশালের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন মানিকচাঁদ। মুর্শিদকুলিই মানিকচাঁদের জন্য ‘শেঠ’ উপাধি জোগাড় করে দেন। সেই টাঁকশাল রয়েছে জগৎ শেঠের বাড়ির মাটির তলায় একটি বিশাল কক্ষে। বর্তমানে এটি সংগ্রহশালা। সূদৃশ্য এই প্রাসাদটিতে আজও বিলাসের নমুনা দেখে অবাক হতে হয়।
মোতিঝিল পার্ক
এরপর একে একে আরও কয়েকটি দ্রষ্টব্য় দেখে নিতে পারেন। যা আপনার টোটো চালক দেখিয়ে দেবে। জগৎ শেঠের বাড়ির অদূরেই দেখে নিন নসিপুর রাজবাড়ি। এর বৈশিষ্ট্য হল এটা হাজারদুয়ারির আদলে তৈরি করা হয়েছে। ভিতরে না ঢুকলেও চলে। এরপর দূর থেকে দেখে নিন নিমকহারাম দেওড়ী। এটা আসলে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের প্রাসাদ। এখানে মীরজাফরের বংশধররা এখনও বাস করেন। তবে এখন ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। এছাড়া দেখুন জাহান কোশা কামান। বিশাল এই কামানের আক্ষরিক অর্থ দুনিয়ার ধ্বংসকারী।
সময় থাকলে সব শেষে আসুন মোতিঝিল পার্কে ঘুরতে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পত্তনে মতিঝিল ভারতীয় ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য মোড়ের সাক্ষী। মতিঝিল ভাগীরথী নদীর এক পরিত্যক্ত বিছানা থেকে গঠিত ৩৫০ একরের অশ্বখুড়াকৃতি হ্রদটি নবাবি আমলে ব্যাপক মুক্তো চাষ থেকে এর নামকরণ হয়েছিল মোতিঝিল। বর্তমানে এখানে সূদৃশ্য পার্ক তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। রয়েছে শিশুদের জন্য নানা খেলার উপকরণ। রয়েছে টয়ট্রেন। আর মোতিঝিলেই রোজ সন্ধ্য়ায় হয় সুন্দর এক লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। যাতে পলাশির যুদ্ধের করুণ ইতিহাস আলো ও শব্দের মুর্ছনায় বর্ণনা করা হয়। বিশ্বাসঘাকতকার সেই ইতিহাস শুনে দেখে চোখে জল আসবে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
কলকাতা ও শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেশ কয়েকটি প্যাসেঞ্জার ও এক্সপ্রেস ট্রেন মুর্শিদাবাদ যায়। লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরেও যেতে পারেন। তবে পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে ভালো ট্রেন হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস। ১৩১১৩ হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস প্রতিদিন সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে ৭.১৯ মিনিটে ব্যারাকপুর ও ৮.১৮ মিনিটে রানাঘাট স্টেশন হয়ে মুর্শিদাবাদ পৌঁছয় সাড়ে ১০টা নাগাদ। ফেরার পথেও এই ট্রেনটি প্রতিদিন বিকেল ৪.৪৪ মিনিটে মুর্শিদাবাদ থেকে ছেড়ে রানাঘাট ব্যারাকপুর হয়ে কলকাতা স্টেশন পৌঁছয় রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ। এছাড়া ধর্মতলা ও বাবুঘাট থেকে প্রচুর সরকারি ও বেসরকারি বাস যায় মুর্শিদাবাদে। সারাদিনের জন্য় টোটো ভাড়া মোটামুটি ৬০০-৭০০ টাকা মতো পড়ে।
থাকার জন্য মুর্শিদাবাদে বহু হোটেল রয়েছে। মোটামুটি ৮০০-১৫০০ টাকার মধ্যে বহু হোটেল পাবেন। তবে সোম থেকে শুক্র একটু কম রেটে ঘর পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদে। শনি ও রবি বা ছুটির দিনে হোটেলের রেট একটু বেড়ে যায়। এরমধ্যে হোটেল ইন্দ্রজিৎ, হোটেল সাগ্নিক, হোটেল মঞ্জুসা অন্যতম। আবার মুর্শিদাবাদে ইউথ হোস্টেলেও থাকতে পারেন।