এই মুহূর্তে




কেন দেবী শাকম্ভরীর শরীরে একশো চোখের আবির্ভাব হয়েছিল?




নিজস্ব প্রতিনিধি: হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রে এমন কিছু দেব-দেবী রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই আমাদের অজানা। তাঁদের মধ্যে কোনও কোনও দেবীর নাম জানলেও কেন তাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বিষয়ে অবগত নন অধিকাংশ সাধারণ মানুষ। জানা যায়,  হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণ মতে দেবী শাকম্ভরী (অর্থাৎ ‘শাক-সবজির ধারিণী’) হলেন মহামায়া আদ্যাশক্তির এক বিশেষ রূপ। আবার তিনি ‘শতাক্ষী’ নামেও পরিচিতা, যার অর্থ “শত নয়নবিশিষ্টা”। দেবী দুর্গার তৃতীয় অবতার হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত উত্তর ভারতের রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, ছত্তিশগড় ও উড়িষ্যা অঞ্চলে তাঁর বিশেষ পূজা প্রচলিত। দেবী শাকম্ভরীকে শস্য, ফলমূল, উদ্ভিদের অধিষ্ঠাত্রী ও পুষ্টির দেবী হিসেবে পুজো করা হয়।

নামের ব্যুৎপত্তি ও তাৎপর্য

‘শাকম্ভরী’ শব্দের অর্থ হল—যিনি ‘শাক’ (সবজি) এবং ‘ভরণ’ (পুষ্টি) দান করেন। দেবীর এই নামের মধ্যেই তাঁর আশ্রয়দাত্রী ও পালনকারিণী স্বরূপের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপর নাম ‘শতাক্ষী’ অর্থাৎ যার শত নয়ন; দেবীর এই রূপ তাঁর সর্বত্র দ্রষ্টা শক্তির প্রতীক, যার দৃষ্টি সমস্ত জগতের দুঃখ, দুর্দশা ও সংকট অনুভব করে।

পুরাণের বর্ণনা: শাকম্ভরী ও শতাক্ষীর আবির্ভাব কাহিনী

দেবী ভাগবত পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ও দুর্গা সপ্তশতী-তে দেবী শাকম্ভরীর মাহাত্ম্য ও আবির্ভাব বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই সকল পুরাণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জানতে পারা যায়, একবার বিশ্বজগত প্রবল দুর্ভিক্ষ ও অনাহারে জর্জরিত হয়। ভয়ঙ্কর অসুর দুর্গমাসুর চতুর্বেদ হরণ করে আধ্যাত্মিক শক্তিকে দুর্বল করে তোলে। ঋষি-মুনিগণ যজ্ঞে আহুতি দিতে অক্ষম হন। ফলস্বরূপ বন্ধ হয়ে যায় বৃষ্টিপাত, ব্যাহত হয় শস্য উৎপাদন। ফলে প্রাণিকুল অনাহারে কষ্ট পেতে থাকে। এই ভীষণ অবস্থায় দেবগণ ও ঋষিরা দেবী মহামায়া পার্বতীর স্তব ও উপাসনা করেন। পরমাপ্রকৃতি দেবী করুণাবশত তাঁদের নিকট উপস্থিত হন। কথিত আছে, এই সময় দেবীর সর্বাঙ্গ জুড়ে শত চোখের সৃষ্টি হয় ও দেবী তাঁর শত চোখ দিয়ে অশ্রু বর্ষণ করেন। সেই অশ্রু নদীতে পরিণত হয়, যা ভূমিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। এই অশ্রুর ফলে পুনরায় ধরণীতে শস্য জন্মাতে শুরু করে, জলধারা প্রবাহিত হয়, পৃথিবী সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে।

পর্যাপ্ত শস্য না হওয়া পর্যন্ত দেবী নিজের দেহে শাক ও ফলমূল উৎপন্ন করে মানুষ ও প্রাণিকুলের ভরণপোষণ করেন। তাই তিনি “শাকম্ভরী” নামে প্রসিদ্ধ হন। তাঁর দেহের শাক, মূল, ফল খেয়ে পৃথিবীবাসী জীবিত ছিল। এই কারণে দেবীকে ‘ত্রিভুবনে শাকম্ভরী’ রূপে অভিহিত করা হয়।

দুর্গমাসুর বধ কাহিনী

তবে দুর্গমাসুরের অত্যাচার শেষ হয়নি। ভগবতী পার্বতী শাকম্ভরী রূপ ধারণ করে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। তাঁর সঙ্গে সাহায্যের জন্য উপস্থিত হন দেবী কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি মহাবিদ্যা দেবীরা। ভয়ঙ্কর যুদ্ধে দেবী পার্বতী দুর্গমাসুরকে বধ করেন এবং ‘দুর্গা’ বা ‘দুর্গতিনাশিনী’ নামে খ্যাত হন। এই কাহিনী দেবীর শক্তি, করুণা ও রক্ষা করার স্বরূপকে একত্রে প্রকাশ করে।

দেবী শাকম্ভরীর মন্দির ও তীর্থস্থান

ভারতের বহু অঞ্চলে দেবী শাকম্ভরীর উপাসনা প্রচলিত, তবে সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দিরগুলি হল:

  • সাহারানপুর, উত্তরপ্রদেশ: এখানে অবস্থিত শাকম্ভরী দেবী শক্তিপীঠ, যা উত্তর ভারতের অন্যতম প্রধান তীর্থ। কথিত, এক রাখাল বালক স্বপ্নে দেবীর দর্শন পেয়ে প্রথম এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করেন।
  • সম্বর, রাজস্থান: সম্বর লেকের তীরে দেবীর একটি অন্যতম প্রাচীন মন্দির রয়েছে। স্কন্দ পুরাণ ও দেবী ভাগবত পুরাণে এই স্থানের উল্লেখ আছে।
  • শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলের মৌসুমী নদীতীরে অবস্থিত আরও এক প্রাচীন মন্দির দেবী শাকম্ভরীর আবির্ভূত স্থান হিসেবে পূজিত।

দেবী শাকম্ভরী উপাসনার তাৎপর্য

দেবী শাকম্ভরীর উপাসনা সাধারণত পুষ্টি, শস্যবৃদ্ধি, শান্তি ও নির্ভয়তার জন্য করা হয়। কৃষিজীবী সমাজে দেবীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষত দুর্ভিক্ষ, খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই দেবীর পুজো করে জনগণ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও অনুকূলতার আশায় থাকেন।

তন্ত্র ও পুরাণ মতে, তিনি দশ মহাবিদ্যার অন্যতম শক্তি; তাঁর শক্তিতে স্তম্ভন (প্রতিরোধ) ও পোষণ, উভয় দিকই রয়েছে। তিনি এই সৃষ্টির পালনকর্ত্রী ।

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, দেবী শাকম্ভরী বা শতাক্ষী দেবী পার্বতীরই এক অসাধারণ মহিমাপূর্ণ রূপ—যিনি শুধু শত্রুনাশিনী নন, বরং স্নেহময়ী মাতার মতো সৃষ্টির রক্ষাকর্ত্রী। তিনি দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা থেকে মুক্তির দেবী, অন্নপূর্ণার এক বিস্তৃত রূপ, যাঁর দৃষ্টি ও অশ্রু পৃথিবীকে নবজীবন দান করে। তাঁর উপাসনা তাই মানব সভ্যতার চিরন্তন চাহিদা—খাদ্য, জল, পুষ্টি ও প্রাণের প্রতীক হয়ে আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

হিন্দুত্বের ছোঁয়া! নজরুলের ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিল মোল্লা ইউনূসের সরকার

ইন্দোনেশিয়ায় জেগে উঠেছে আগ্নেয়গিরি, প্রবল অগ্ন্যুৎপাতে জারি হল কড়া সতর্কতা

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনায় একই গ্রামের ১৪ বাসিন্দা প্রাণ হারিয়েছেন

জুয়ার নেশায় সর্বস্বান্ত, ২৩ লাখ খুইয়ে চুরিতে হাত পাকাল M.Tech ইঞ্জিনিয়ার

‘পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেন, জেলে পাঠানো হবে’, ATS অফিসার সেজে বৃদ্ধার সঙ্গে ২২ লক্ষ টাকা প্রতারণা

FASTag নিয়ে নীতিন গড়করির বড় ঘোষণা, এবার গাড়ি থাকলেই পকেট গড়ের মাঠ

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ