এই মুহূর্তে




জেনে নিন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের নিয়ন্ত্রক শক্তি ভুবনেশ্বরীর মাহাত্ম্য




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় :           হ্রীং ভুবনেশ্বর্যৈ নমঃ

তিনি পরমাপ্রকৃতি আদ্যাশক্তি মহামায়া, তিনি স্বয়ং নির্গুণব্রহ্মের দুই মূর্ত রূপ, পুরুষ ও প্রকৃতি, তিনি মহাদেবীর সর্বোচ্চ মূর্ত প্রতীক। তিনিই দেবী ভুবনেশ্বরী (সংস্কৃত: भुवनेश्वरी), যিনি হিন্দুধর্মের শক্তিসাধনা ও তন্ত্রশাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবী। তিনি দশ মহাবিদ্যার মধ্যে চতুর্থ এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের নিয়ন্ত্রক শক্তি। তাঁর নাম থেকে অতি সহজেই বোঝা যায় যে, তিনি “ভুবনের ঈশ্বরী” — অর্থাৎ জগতের বা মহাবিশ্বের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি আদিমাতা মূলা প্রকৃতি ও প্রথমা মহাবিদ্যা কালীর সঙ্গে অভিন্নতা বিধায় তিনি রক্তা বা রক্তকালী নামে পরিচিতা। আবার মহাভাগবত পুরাণে তাঁর অরুণবর্ণা ত্রিনেত্রা চতুর্ভুজা বরাভীতিপাশাঙ্কুশধারিণী মূর্তি দুর্গার তান্ত্রিক রূপ বলে বর্ণিত। ত্র্যম্বক শিব তাঁর ভৈরব। মহাবিশ্বের সবকিছুর জন্ম হয় তাঁরই মধ্যে এবং শেষ পর্যন্ত সবকিছু তাঁরই মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

নাম ও ব্যাখ্যা

  • ভুবনেশ্বরী = ভুবন + ঈশ্বরী → “বিশ্বের রাণী” বা “মহাবিশ্বের সম্রাজ্ঞী”।
  • তিনি পরম পুরুষ ত্র্যম্বকের শক্তিরূপিণী।

তন্ত্রশাস্ত্র ও পুরাণ অনুযায়ী, ভুবনেশ্বরী হলেন সেই সর্বময় শক্তি, যিনি অনন্ত মহাবিশ্বকে সৃষ্টি, ধারণ ও বিলয় করেন।

পৌরাণিক উৎস ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, সৃষ্টির আদিতে ত্রিদেব— ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব জানতেন না তাঁরা কারা এবং তাঁদের ভূমিকা কী। হঠাৎ এক দিব্য রথ এসে তাদের নিয়ে যায় রত্নদ্বীপ নামক এক অলৌকিক স্থানে। সেখানে তারা নিজেরাই নারীতে রূপান্তরিত হন এবং এক অলৌকিক শহরে পৌঁছান , যা ছিল ন’টি পর্দা, ভৈরব ও যোগিনীতে রক্ষিত।

সেখানে তাঁরা দেখা পান দেবী ভুবনেশ্বরী-র, যিনি চিন্তামণি গৃহে বিরাজমান। তিনি চতুর্ভুজা, ত্রিনয়নী, লালবর্ণা এবং রক্তবসনা। তাঁর হাতে বর, অভয়, পাশ ও অঙ্কুশ। তিনি অলঙ্কার ও রক্তচন্দন দ্বারা শোভিতা এবং চন্দ্রকলাঙ্কিত মুকুট পরিহিতা।

এই দেবী আদ্যাশক্তি স্বরূপিণী, যিনি নিজেই স্বামীরূপে ত্র্যম্বক (শিব) সৃষ্টি করেন। ত্র্যম্বককে তাঁর ত্রিবিধ লীলা সম্পাদনে সহায় করতে তিনি তিনটি শক্তিরূপ— সরস্বতী, লক্ষ্মী ও কালী—রূপে প্রকাশিত হন। এইভাবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব—ত্রিমূর্তি তাদের সহধর্মিণী ও কর্মশক্তি লাভ করেন।

তন্ত্র ও মহাবিদ্যার দর্শনে স্থান

দশ মহাবিদ্যা হিন্দু তান্ত্রিক শাক্ত দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ। এর মধ্যে ভুবনেশ্বরী হলেন:

  • সৃষ্টি এবং চেতন শক্তির আধার।
  • প্রকৃতি ও পুরুষ—নির্গুণ ব্রহ্মের দুই রূপের মধ্যে প্রকৃতি।
  • মহাশক্তির দেহতত্ত্ব ও মহাবিশ্বতত্ত্বের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
  • তন্ত্র অনুযায়ী, তিনি সমস্ত রূপের আদি—শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি তাঁর মধ্যেই।

রূপ ও উপাসনার বৈশিষ্ট্য

ভুবনেশ্বরীর মূর্তিতে দেখা যায়:

  • লাল বর্ণের গাত্র (রক্তবর্ণা বা অরুণবর্ণা)
  • ত্রিনয়ন (সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নি প্রতীক)
  • চতুর্ভুজা (বর, অভয়, পাশ, অঙ্কুশ ধারিণী)
  • চন্দ্রকলামুকুট, রক্তচন্দনে শোভিত দেহ
  • পদ্মের মালা ও রক্তালঙ্কার পরিহিতা

তাঁর সাধনায় প্রাপ্ত ফল:

  • মানসিক স্থিতি, ধ্যান ও আধ্যাত্মিক উন্নতি
  • জীবনের বাধা দূরীকরণ
  • গভীরতর আত্মজ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ

বিখ্যাত কিংবদন্তি: কৌশল্যর ভক্তি

একটি কাহিনিতে উল্লেখ আছে, এক ভক্ত কৌশল্যা বারাণসীর তীরে গঙ্গার ধারে ধ্যান করে দেবীর দর্শন লাভ করেন। দেবী বিশাল চোখ, করুণাময় রূপে আবির্ভূত হন এবং তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন। এই ঘটনা দেবীর ভক্তিরূপে প্রকাশ এবং ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতার চিহ্ন বহন করে, যা পরবর্তীতে ভুবনেশ্বরীর একটি বিশেষ রূপ — বিশালাক্ষী নামেও পরিচিত হয়।

উপাসনা ও উদ্দেশ্য

ভুবনেশ্বরী সাধনার উদ্দেশ্য:

  • মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি
  • জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সাফল্য
  • শক্তি, জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞানের সমন্বিত উপলব্ধি
  • তাঁর মন্ত্র সাধনা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং তাঁকে আরাধনা করলে শিষ্য তার জীবন ও সংসারে স্থিতি আনতে পারেন।

ভুবনেশ্বরী মন্দিরসমূহ

ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভুবনেশ্বরীকে উৎসর্গীকৃত বহু মন্দির রয়েছে:

  • ত্রিপুরা: রাজরাজেশ্বরী/ভুবনেশ্বরী মন্দির।
  • কেরালা: এর্নাকুলাম, আডুর ও চুরাকোডুতে বিখ্যাত ভুবনেশ্বরী মন্দির।
  • ওড়িশা: পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে দেবী সুভদ্রা ভুবনেশ্বরী রূপে পূজিত হন এবং ভুবনেশ্বর শহরের লিঙ্গরাজ মন্দিরে মহাদেবের সহধর্মিনী রূপে ভুবনেশ্বরী দেবীর পূজা করা হয়। এছাড়া, ওড়িষার সামলেশ্বরী মন্দির এবং কটক চণ্ডী মন্দিরেদেবী ভুবনেশ্বরীর পূজা হয়।
  • কর্ণাটক: মহীশূরের রাজপ্রাসাদের পাশে এক মন্দির।
  • তামিলনাড়ু: পুডুকটাই অঞ্চলে এক বিখ্যাত ভুবনেশ্বরী মন্দির।
  • আসাম: কামাখ্যার কাছে একটি পৃথক মন্দির।
  • গুজরাট: গোন্দা শহরে ১৯৪৬ সালে নির্মিত মন্দির।
  • মহারাষ্ট্র: চাংলি জেলার বিখ্যাত ভুবনেশ্বরী মন্দির।
  • পশ্চিমবঙ্গ: হুগলির চন্দননগরে চালকেপাড়া ভুবনেশ্বরী মন্দির।
  • উত্তর আমেরিকা: মিশিগানের পন্টিয়াকে ‘পরাশক্তি মন্দির’ ।

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, দেবী ভুবনেশ্বরী কেবল এক শক্তিরূপী দেবী নন, তিনি আদ্যাশক্তির প্রতিচ্ছবি—একাধারে সৃষ্টি, পালন ও সংহার পরিচালনাকারী। তন্ত্র ও পুরাণে তাঁর গুরুত্ব অতুলনীয়। ভুবনেশ্বরী সেই সর্বজনীন শক্তির মূর্ত রূপ যিনি সৃষ্টির মূল কেন্দ্রবিন্দু। তন্ত্র, যোগ ও আধ্যাত্মিকতা অনুসন্ধানকারীদের কাছে ভুবনেশ্বরীর আরাধনা এক অনিবার্য পথ—যার মাধ্যমে জাগতিক মায়া ভেদ করে অন্তর্নিহিত পরম সত্যে পৌঁছানো যায়।




Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

‘ভারত আগে ছিল, আগেই থাকবে’, বাড়ি ফেরার পথে জানিয়ে গেলেন পূর্ণম

নির্মম! গাছের নিচে ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির উপর ময়লা ফেলে নৃশংসভাবে খুন পুরকর্মীর

‘ভেঙে পড়েছে ভারতের বিদেশনীতি’, বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে তীব্র আক্রমণ রাহুল গান্ধির

জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার আপ বিধায়ক রমন অরোরা

‘কোটাতেই শুধু কেন পড়ুয়ারা আত্মহত্যা করছে?’, রাজস্থান সরকারকে ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের

এক বছরে কতটা প্রত্যাশা পূরণ? জনতা জনার্দনের রায় জানতে সমীক্ষা চালাচ্ছে oneindia

Advertisement




এক ঝলকে
Advertisement




জেলা ভিত্তিক সংবাদ