নিজস্ব প্রতিনিধি: অতিদ্রুত কী বদলে যাচ্ছে দেশের রাজনীতি! প্রশ্নটা উঠেই গেল বাংলার রাজ্যপালের শিরদাঁড়া সোজা রেখে বিজেপির বিক্ষোভের মধ্যে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজ্য বিধানসভা(State Legislative Assembly) ত্যাগ করার ঘটনায়। কার্যত জগদীপ ধনখড়(Jagdeep Dhankar) বাংলায় আসা ইস্তক তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্যের শাসক দল ও বাম-কংগ্রেস বার বার অভিযোগ তুলছিল কেন্দ্রের শাসক দলের এজেন্ট হিসাবে কাজ করার। একই সঙ্গে এখানে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্য সরকার, রাজ্যের শাসক দল মায় রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষের সঙ্গেও ধারাবাহিক ভাবে রাজ্যপালের বিরোধ বাঁধতে দেখা গিয়েছে একাধিক ইস্যুতে। সেই রাজ্যপালই কিনা সোমবার রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির(BJP) বিক্ষোভের জেরে ক্ষুব্ধ হয়ে বিধানসভা ছেড়ে চলে গেলেন। কার্যত নজীরবিজীন ঘটনা। এর আগে যেমন বিরোধীদের বিক্ষোভে রাজ্য বিধানসভার কোনও অধিবেশনের প্রথম দিনেই রাজ্যপালকে যেমন বিধানসভার অধিবেশন কক্ষ ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়নি, তেমনি জগদীপ ধনখড়কেও বিজেপির আচরণে কোনওদিন ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়নি। আর এখানেই প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় রাজনীতিতে কী কোনও পরিবর্তনের আভাস পেয়েছেন মাননীয় রাজ্যপাল, যে এবার তিনি বিজেপির থেকে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে দিলেন!
ঠিক কী হয়েছিল এদিন? প্রথানুসারে রাজ্য বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন শুরুর দিনে বাজেট বক্তৃত্বা করতে এসেছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। বিধানসভা ভবনের বাইরে তাঁকে স্বাগত জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee) ও রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর দেশের সংবিধানের প্রণেতা বাবা সাহেব আম্বেদকারের মূর্তিতে মাল্যদান করে তাঁরা এগিয়ে যান বিধানসভা অধিবেশন কক্ষের দিকে। সেখানে রাজ্যপাল তাঁর ভাষণ শুরুর আগেই বিজেপির বিধায়কেরা ওয়াল থেকে নেমে এসে রাজ্যপালের সামনে চিৎকার করতে করতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে ওঠে শ্লোগান, ‘ভারত মাতা কী জয়’, ‘ছাপ্পা ভোটের সরকার আর নেই দরকার’, ‘মানুষ মারা সরকার, আর নেই দরকার’ ইত্যাদি। রাজ্যপাল সেই সময় তাঁদের আসনে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। যদিও সেই অনুরোধ কানে তোলেনি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নির্দেশে চলা গেরুয়া শিবিরের বিধায়কেরা। তার জেরে রাজ্যপাল তাঁর চেয়ারে বসে পড়েন। সেই সময় শাসক শিবির থেকে রাজ্যপালকে অনুরোধ করা হয় ভাষণ শুরু করার জন্য। রাজ্যপাল ভাষণ শুরু করার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে আবারও বিজেপি বিধায়কদের অনুরোধ করেন তাঁকে ভাষণ পড়তে দিতে। কেননা রাজ্যপালের অভিমত ছিল, রাজ্যপালকে তাঁর ভাষণ পড়তে না দেওয়া কার্যত গণতন্ত্রের ওপর আঘাত।
যদিও রাজ্যপালের কথা কানে তোলেননি বিজেপির বিধায়কেরা। এমনকি বেশ কিছু বিধায়ক সেই সময় মাটিতে বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সেই সময় স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি বিধায়কদের অনুরোধ করেন বিক্ষোভ থামাতে। কিন্তু সেই কথাও রাখেননি বিজেপির বিধায়কেরা। ওই সময় দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে এগিয়ে আসতে। তিনিও হাতজোড় করে বিজেপির বিধায়কদের বিক্ষোভ থামাতে ও রাজ্যপালকে ভাষণ শুরু করতে বলেন। কিন্তু বিজেপির বিক্ষোভে রাজ্যপাল বিরক্ত হয়ে বিধানসভা ভবনের অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করতে চাইলে, রাজ্যপালের সামনে এসে দাঁড়ান রাজ্যের দুই মহিলা মন্ত্রী শশী পাঁজা ও চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের সঙ্গে তৃণমূলের(TMC) মহিলা বিধায়কেরা। তাঁরা রাজ্যপালকে অনুরোধ করেন বাজেট ভাষণ পড়ার জন্য। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীকেও দেখা যায় রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতে। এরপরে রাজ্যপাল আলাদা আলাদা করে নিজের কাছে ডেকে কথা বলেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে রাজ্যপাল তাঁর বাজেট বক্তৃত্বার প্রথম এবং শেষ লাইন পড়ে তাঁর ভাষণ শেষ করেন ও অধিবেশন কক্ষ ছেড়ে বেড়িয়ে যান। তাঁকে বিদায় জানান মুখ্যমন্ত্রী ও অধ্যক্ষ।
এদিন বিজেপি যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শুরু করে তখন তৃণমূলের বিধায়কেরাও পাল্টা শ্লোগান দিতে শুরু করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে দেওয়া শ্লোগান, ‘চোর চোর চোরটা, শিশিরবাবুর ছেলেটা।’ ছিল শ্লোগান, ‘বিজেপি হঠাও ভারত বাঁচাও’। তবে এদিনের ঘটনার জেরে রাজ্যপাল বিধানসভা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে বিজেপির বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কাছে নিজের ক্ষোভ উগরে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিজেপি যা করেছে, তা ঠিক নয়। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। ওরা ইচ্ছে করে নাটক করল। রাজ্যপাল ভাষণ দিতে পারলেন না এটা অভূতপূর্ব। বিজেপি যা করেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। নির্বাচিত সরকারকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি মর্মাহত। এতে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হতে পারত।’