নিজস্ব প্রতিনিধি: পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার রামনগর-২ ব্লকের কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের মন্দারমণি(Mandarmani) এখন অনেক মানুষের কাছেই খুব প্রিয় ডেস্টিনেশন হয়ে উঠেছে। সপ্তাহন্তে বা ছুটির দিনগুলিতে এই সৈকতগ্রামে অনেক শয়ে শয়ে মানুষ ভিড় জমান। আর এই পর্যটকদের হাত ধরেই মন্দারমণিতে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে একের পর এক হোটেল ও রিসর্ট। তার জেরে সেখানে পর্যটন শিল্পও ক্রমশ ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছিল। কিন্তু এবার সেই পর্যটন শিল্পেই নেমে এল বড় ধাক্কা। জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায় মেনে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ মন্দারমণিতে ৫০টি হোটেল-রিসর্ট(Hotel and Resort) বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেছে। আর সেই নির্দেশের জেরেই সেখানে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় ৬০০ জন ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ৬ হাজার মানুষ কাজ হারাতে চলেছেন। সমস্যার সমাধান চেয়ে মন্দারমণি হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপও চাওয়া হয়েছে।
প্রায় এক দশক ধরে মন্দারমণিতে একরকম বেআইনি ভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে একের পর এক হোটেল ও রিসর্ট গড়ে উঠেছে। যারা দিঘার ভিড় পছন্দ করেন না তাঁরা অনেকেই এখানে ভিড় করেন। পাশাপাশি এখানকার সৈকতের লাল কাঁকড়াও অনেকের খুব পছন্দ। ছুটির দিনগুলি ছাড়াও অনান্য দিনে এখানে বেশ ভালই পর্যটকদের ভিড় হয়। কিন্তু তার মাঝেই বার বার প্রশ্ন উঠেছে সেখানে গড়ে ওঠা কংক্রিটের জঙ্গল নিয়ে। সেখানকার হোটেল ও রিসর্টগুলির বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠেছে পরিবেশবিধি মেনে না চলার। অভিযোগ, ওই সব হোটেল ও রিসর্টগুলি যেমন উপকূল সুরক্ষা বিধি(Costal Regulation Act) মেনে তৈরি হয়নি তেমনি সেগুলির পরিচালনার ক্ষেত্রেও পরিবেশবিধি মেনে চলা হচ্ছে না। মন্দারমণিতে এমন বেশ কিছু হোটেল ও রিসর্ট রয়েছে যেগুলির ভেতরে জোয়ারের জল ঢুকে যায়। একদম সৈকতের ওপরে ওই সব হোটেল ও রিসর্ট গড়ে ওঠায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছিল ক্রমশ। সেই সঙ্গে হোটেলগুলির দূষিত জল ও অনান্য দ্রব্য সরাসরি সমুদ্রে মিশে সাগরের জলকেও দূষিত করে তুলছিল।
এইসবের জেরেই জাতীয় পরিবেশ আদালতে(National Green Tribunal) দায়ের হায় মামলা। সেই মামলাতেই দাবি করা হয়, বার বার আদালত নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পরিবেশবিধি মেনে চলছে না ওই সব হোটেল ও রিসর্ট। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের(West Bengal Pollution Control Board) কাছ থেকেও হোটেল ও রিসর্ট চালানোর ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। তার জেরে পর্ষদের তরফে হোটেলগুলিকে আগে শোকজও করা হয়েছিল। কিন্তু তার জেরে কোনও উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা কার্যত উদাসিনই থেকেছে তাঁরা। জাতীয় পরিবেশ আদালতে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে জানানো হয়েছিল, মন্দারমণিতে গড়ে ওঠা অনেক হোটেল ও রিসর্ট পরিবেশবিধির তোয়াক্কা করছে না। উপকূল সুরক্ষার বিধি মেনে বর্জ্য পরিশোধনকেন্দ্র বা ইটিপি তৈরির কথা। কিন্তু তা না করে অপরিশোধিত জলই হোটেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সাগরের বুকে। ২০২১ সালে এই হোটেলগুলি তিন বার পরিদর্শন করা হয়েছিল। সেই সময়ে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্রের ব্যাপারে হোটেল কর্তৃপক্ষগুলিকে জানানোও হয়। কিন্তু তারপরেও হুঁশ ফেরেনি তাঁদের।
পর্ষদের বক্তব্য, ১৯৭৪ সালের জলদূষণ বিরোধী আইনের ২৫ ও ২৬ নম্বর ধারা এবং ১৯৮১ সালের বায়ুদূষণ বিরোধী আইনের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকলে এই ভাবে কোনও রিসর্ট বা হোটেল চালানো যায় না। কিন্তু সেই আইনের ভ্রুক্ষেপই করছে না কেউ। এরপরেই জাতীয় পরিবেশ আদালত ওই সব হোটেল ও রিসর্ট বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের জেরে এবার কড়া পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে রাজ্য সরকার। উপকূল সুরক্ষাবিধি অমান্য এবং প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র না-থাকায় মন্দারমণিতে ৫০টি হোটেল ও রিসর্টকে বন্ধ করার নির্দেশ বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিল পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে মন্দারমণি কোস্টাল থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অবিলম্বে এই ৫০টি হোটেল-রিসর্ট বন্ধ করে দিতে হবে। আদালতের নির্দেশ যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয় সেই বিষয়েও তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে একসঙ্গে এতগুলি হোটেল ও রিসর্ট বন্ধ করে দিলে তার ধাক্কা সরাসরি পড়বে স্থানীয় অর্থনীতিতে। ধাক্কা খাবে সেখানকার পর্যটন শিল্পও।