নিজস্ব প্রতিনিধি: প্রবীন মৃৎশিল্পী একটানা কয়েকদিন কাজ করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বিশ্রাম নেওয়ার মতো হাতে সময় তো নেই, বরং রাত জেগে কাজ করতে পারলেই ভাল। মাত্র কয়েকদিন পর দেবীর বোধন। রাত জেগে কাজ করে চলেছেন সেই বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী। ক্লান্তিতে তাঁর চোখের পাতা মাঝেমধ্যেই বুজে আসছে। কিন্তু সেই রাতেই মূর্তির গায়ের রঙ সেরে ফেলতে হবে। রাত জেগে নিভে আসা হ্যারিকেনের আলোতেই তিনি কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু ভোরের আলো মূর্তির গায়ে পড়তেই চমকে উঠলেন তিনি। কেননা তিনি দেখলেন, সারারাত ধরে তিনি মূর্তির গায়ে যে রং করেছেন সেই রঙ অপরাজিতা নীল। মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল খবর। রং দেখে মুষড়ে পড়লেন সকলেই। এমন সময় বাড়ির কর্তা চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায় হাজির হলেন। জানালেন, চিন্তার কিছু নেই। রাতে দেবী তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন, যেন অপরাজিতা রঙেই দেবীর পুজো করা হয়। সেই থেকেই চট্টোপাধ্যায় পরিবারে অপরাজিতা রঙে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী। গোটা কৃষ্ণনগরবাসীর কাছে তিনি নীল দুর্গা(Neel Durga)।
নদিয়া(Nadia) জেলার কৃষ্ণনগরের(Krishnanagar) নাজিরাপাড়ার(Najira Para) চট্টোপাধয়ায় পরিবারে যে দুর্গা পুজো(Chattopadhay Family Durga Puja) হয় তার গায়ের রঙ নীল। ইতিমধ্যেই ৩০০ বছর পার হয়ে গিয়েছে এই পুজোর ইতিহাস। এই পরিবারের শিকড় ওপার বাংলার বরিশালের বামরাইল গ্রামে। সেই গ্রামের বাড়িতেই নাকি প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে এই নীল দুর্গা পুজো শুরু হয়েছিল। তাদেরই এক পূর্বপুরুষ, তন্ত্রসাধক, দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন। তবে একেবারে শুরু থেকেই যে নীল দুর্গার পুজো হত তা কিন্তু নয়। তবে রামাইল গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবারেই নীল দুর্গার পুজো শুরু হয়েছিল। দেশভাগের পর চট্টোপাধ্যায় পরিবার চলে আসেন এপার বাংলায়। কৃষ্ণনগরের নাজিরাপাড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। ১৯৪৭ সাল থেকে এখানেই শুরু হয় নীল দুর্গার পুজো। প্রথম দেখায় এখানে দুর্গাকে দেখে মনে হবে দক্ষিণাকালী৷ এখানে সরস্বতীর পাশে কার্তিক থাকেন না, থাকেন গণেশ। আবার লক্ষ্মীর পাশে থাকেন কার্তিক।
কেবল মূর্তির গায়ের রংই নয়, মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠানেও এই পুজো আলাদা করে নজর কাড়ে। উল্টো রথের দিন দেবীর পটে মাটি পড়ে। হয় পট-পুজো। সন্ধি পুজোতে লাগে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল। পুজো হয় শাক্ত মতে। প্রতিদিন দেবীকে মাছের ভোগ দেওয়া হয়। তালিকায় থাকে রুই-ইলিশ। দশমীর দিন পান্তা ভাত, কচুর শাক, মটর ডালের বড়ার সঙ্গে দেওয়া হয় গন্ধরাজের বড়া। নবমীর দিন হয় শত্রু নিধন বা শত্রু বলি। আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় মানুষের মূর্তি। সেটা লাল শালু দিয়ে মুড়ে পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য সদস্য খাঁড়া দিয়ে কোপাতে থাকেন। সঙ্গে থাকেন পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যরা। পরিবারের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে পরিবারের শত্রু নিধন করা হয়। দশমীর দিনে দেবীকে পান্তা ভাত খাইয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্য বিদায় জানানো হয়।