নিজস্ব প্রতিনিধি: দেশজুড়ে পয়গম্বর বিতর্কের নেপথ্যে ছিল বিজেপির সর্বভারতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মার মন্তব্য। সেই বিতর্কের আঁচ বেশ ভালই ধাক্কা দিয়েছে বাংলার জনজীবনকে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাংলার(Bengal) বুকে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল নানা জেলায়। সেই অশান্তির আঁচে পুড়েছে হাওড়া জেলার পাঁচলা, মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা ও নদিয়া জেলার বেথুয়াডহরি। সেই অশান্তির রেশ কাটার আগেই আবারও বাংলাজুড়ে শুরু হয়ে গেল ‘অগ্নিপথ’(Agnipath) নিয়ে বিক্ষোভ-অবরোধ। বৃহস্পতিবার যা শুধু উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ভাটপাড়ায়(Bhatpara) দেখা গিয়েছিল শুক্রবার সকালে সেটাই ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল বনগাঁ মহকুমার ঠাকুরনগর(Thakurnagar) এবং খাস কলকাতায় হাওড়া ব্রিজের(Howrah Bridge) ওপরে।
সেনায় চার বছরের নিয়োগ প্রকল্প অগ্নিপথের বিরোধিতায় উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর স্টেশনে এদিন সকাল থেকেই শুরু হয় অবরোধ। ট্রেন অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। আর তার জেরে পূর্ব রেলেরব শিয়ালদা-বনগাঁ শাখায় ব্যাহত হয়েছে ট্রেন চলাচল। ব্যস্ত সময়ে চরম দুর্ভোগে পড়েন নিত্যযাত্রীরা। সকাল ৭টা ৫০ মিনিট নাগাদ অবরোধ শুরু হয়। অবরোধের জেরে দাঁড়িয়ে ডাউন বনগাঁ-মাঝেরহাট লোকাল। যদিও রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, আপ লাইনে গোবরডাঙা পর্যন্ত ট্রেন চলছে। কিন্তু চূড়ান্ত নাকাল হচ্ছে বনগাঁ থেকে কলকাতামুখী নিত্যযাত্রীরা। কিন্তু কেন বিক্ষোভ? কি আছে এই ‘অগ্নিপথ’ প্রক্লল্পে।
সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য সম্প্রতি ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। তার আওতায় সেনা, নৌসেনা এবং বায়ুসেনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা জানানো হয়। বলা হয়, ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের আওতায় চার বছরের জন্য ‘অগ্নিবীর’ নিয়োগ করা হবে। প্রথম বছর এই ‘অগ্নিবীর’রা পাবেন মাসে ৩০ হাজার টাকা। চতুর্থ বছরে সেই টাকার অঙ্ক দাঁড়াবে ৪০ হাজারে। আয়ের ৩০ শতাংশ তাঁরা জমাতে পারবেন। সম পরিমাণ টাকা দেবে সরকারও। নয়া প্রকল্পে চার বছরের মেয়াদ শেষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ২৫ শতাংশকে স্থায়ী কর্মী হিসেবে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। বাকি ৭৫ শতাংশ আর সেনাবাহিনীতে রাখা হবে না। সেই সময় তাঁদের দেওয়া হবে ১০-১১ লক্ষ টাকা ভাতা, যা হবে সম্পূর্ণ করমুক্ত। চার বছর পর স্কিল গেইন সার্টিফিকেট, ক্রেডিট ফর হায়ার এডুকেশন সার্টিফিকেট পাবেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা। তবে অবসরের পরে ওই ৭৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’রা সেনাবাহিনীর অবসরকালীন কোনও সুবিধা পাবে না। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে চুক্তিভিত্তিক ওই অগ্নিবীররা নিজেদের ‘প্রাক্তন সেনাকর্মী’ বলে উল্লেখও করতে পারবেন না। পাবেন না পেনশন কিংবা গ্র্যাচুইটির সুবিধাও। তবে চার বছর কর্মরত অবস্থায় কোনও ‘অগ্নিবীর’এর মৃত্যু বা অঙ্গহানি হলে মিলবে আর্থিক সাহায্য। আগামী ৩ মাসের মধ্যেই দেশজুড়ে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র। আর এখানেই দেখা দিয়েছে সমস্যা।
ঠাকুরনগরে এদিনের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারী তরুণ-যুবা-কিশোরদের বক্তব্য, ‘চার বছরের জন্য নিয়োগ করবে। প্রথম মাসে ৩০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় বছরে ৩৩ হাজার, চতুর্থ বছরে ৩৬ হাজার। তার পর ১১ লাখ ৭১ হাজার টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। আমরা কি কোনও বিদেশে কাজে যাচ্ছি না কি? যারা দেশের জন্য জীবন দিচ্ছে, তাদের এই সুযোগ! তাঁদের সঙ্গে এই ব্যবহার! যারা নিজেদের জীবন দিয়ে দেশ রক্ষার কাজ করবে তাঁদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে দেশের সরকার! কেন প্রাক্তন সেনাকর্মী বলেও পরিচয় দিতে পারবে না! তাঁরা কী অপরাধী? যারা দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, তাদের জন্য এই সুবিধা! আর যারা দেশে লুটেপুটে খেয়ে বড় হচ্ছে, তারা এক-দেড়েক লাখ ভাতা পাচ্ছে। তাদের ছেলে আইএএস অফিসার হবে। আমরা সাধারণ পরিবার কি এ ভাবে মারা যাব? সরকার যখন যা সিদ্ধান্ত নেবে, সব মেনে নিতে হবে? আমাদের বয়স পেরিয়ে গিয়েছে। দেশকে অনেকটা ভালোবাসি আমরা। আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিই। চার বছরের জন্য সেনায় নিয়োগের সিদ্ধান্ত মানতে চাই না। চার বছর পর যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তখন কী করব আমরা?’
বস্তুত এই একই প্রশ্ন সারা দেশের বিক্ষোভকারীদের। গতকাল থেকেই এই ঘটনায় বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ। এদিন তা ছড়িয়ে পড়ল বাংলার বুকেও। যদিও এই বিক্ষোভের জেরে বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নিপথ প্রকল্পে নিয়োগের নিয়ম কিছুটা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয় মোদী সরকার। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ায় কেন্দ্র। আবেদনের বয়স ২১ থেকে বাড়িয়ে ২৩ করা হয়েছে। কিন্তু যে মনোভাব দেশের যুব-তরুণ ও কিশোরদের জন্য দেখাচ্ছে মোদি সরকার তা মেনে নিচ্ছে না দেশের তরুণ প্রজন্ম। কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পের বিরোধিতায় শুক্রবার সকালে হাওড়া ব্রিজ অবরোধ করে বিক্ষোভে সামিল হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাওয়া যুবক ও তরুণেরা। হাওড়া ব্রিজে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামেন বিক্ষোভকারীরা। যার জেরে দুর্ভোগে পড়েন অফিসযাত্রীরা। বিক্ষোভ আটকাতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ।