নিজস্ব প্রতিনিধি: উনিশের লোকসভা ভোটে বাংলার মাটিতে বিজেপির যে ঐতিহাসিক উত্থান দেখতে পাওয়া গিয়েছিল তা এসেছিল মূলত ৪টি ভোট ব্যাঙ্কের হাত ধরে। এর মধ্যে একটি ছিল মতুয়া(Matuya) ভোট ব্যাঙ্ক যারা দীর্ঘদিন ধরেই এদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছে। তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেখিয়েই বিজেপি বাজিমাত করেছিল উনিশের ভোটে। সেই প্রতিশ্রুতির অঙ্গ হিসাবেই Citizenship Amendment Act বা CAA-কে সামনে আনা হয়েছিল। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল দ্রুত এই আইন রূপায়িত হবে। কিন্তু এখনও সেই আইনের কোনও বাস্তবায়নের পথে হাঁটাই দিতে পারেনি মোদি সরকার। এর মাঝে যখন আরও একটা লোকসভা নির্বাচন দুয়ারে এসে হাজির হয়েছে তখন মতুয়া গড় ঠাকুরনগরে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি ফের CAA-কে সামনে নিয়ে এসেছেন। বলেছেন, ‘বনগাঁর বিজেপি(BJP) সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের(Shantanu Thakur) সই করে দেওয়া সঙ্ঘ সদস্যের কার্ডই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।’ এই ঘোষণাকেই এবার তীব্র কটাক্ষ হেনে তৃণমূলের(TMC) মুখপাত্র কুণাল ঘোষ(Kunal Ghosh) জানালেন, ‘শান্তনু ঠাকুর সই আবার কী! ভোটের আগে সম্পূর্ণ পাগলের প্রলাপ।’
CAA-কে সামনে রেখেই বিজেপি বাংলার তথা দেশের মতুয়া ভোট নিজেদের পকেটে ভরার পথে নেমেছিল। মতুয়াদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এই আইন লাগুর মাধ্যমেই তাঁদের এদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর তা দেশের সংসদে পাশও হয়ে যায়। এ বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আগত নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরকিত্ব পাওয়ার সুযোগ হয়েছে এই বিলের মাধ্যমে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ১২ মাস টানা ভারতে থাকার নিয়মের সঙ্গে বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতবাস জরুরি ছিল। নতুন সংশোধনীতে দ্বিতীয় অংশে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। উপরিউক্ত দেশগুলি থেকে আসা নির্দিষ্ট ৬টি ধর্মাবলম্বীদের জন্য ১১ বছর সময়কালটিকে নামিয়ে আনা হয়েছে ৫ বছরে। কিন্তু এই আইন লাগু করার মতো সহায়ক আইন এখনও তৈরি করতেই পারেনি মোদি সরকার। তাই এই আইন লাগুও হয়নি দেশে।
এই অবস্থায় তৃণমূল সহ দেশের বিজেপি বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, কার্যত মিথ্যা ও ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে মতুয়া ভোট করায়ত্ত করতেই পদ্মশিবির বার বার নির্বাচনের মুখে CAA-কে সামনে নিয়ে আসছে। এমনকি বিরোধীদের এই মতকে শক্ত করেছে দেশের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর রিপোর্টও। তাঁদের মতে এই বিলের মাধ্যমে শুধুমাত্র ৩১,৩১৩ জন উপকৃত হবে। যাদের মধ্যে আছে ২৫,৪৪৭ জন হিন্দু, ৫৮০৭ জন শিখ, ৫৫ জন খ্রিষ্টান, ২ জন বৌদ্ধ ও ২ জন পার্সি। কার্যত দেখা যাচ্ছে মতুয়াদের মধ্যেও CAA নিয়ে ভুল ভাঙছে। উনিশের লোকসভা ভোটে বিজেপি যেভাবে একচেটিয়া ভাবে মতুয়া ভোট পেয়েছিল, একুশের বিধানসভা ভোটে কিন্তু তা আর হয়নি। বিশেষ করে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তীকালে বাংলায় হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিষ্কার ভাবে বোঝা গিয়েছে, বাংলার মতুয়া ভোট কার্যত হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বিজেপির। এই অবস্থায় গতকাল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার গাইঘাটা ব্লকের ঠাকুরনগরে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি ফের CAA তাস খেলেছেন। তাঁর দাবি, ‘নাগরিরত্বের প্রমাণ স্বরূপ আধার কার্ড না থাকলেও কুছ পরোয়া নেই। বনগাঁ বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের সই করে দেওয়া সঙ্ঘ সদস্যের কার্ডই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। যেসব মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ২০১৪ সালের আগে এদেশে যারা এসেছেন তাদের কোনও ভয় নেই। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতির দেওয়া কার্ডে বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের সই থাকলেই দেশের যেকোনও জায়গায় যাওয়া যাবে। ওটাই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হবে।’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই দাবিকেই এদিন তীব্র কটাক্ষ হেনেছেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তিনি জানিয়েছেন, ‘এটা তো কাজের কথা হল না। যাদের ভোটার লিস্টে নাম আছে, যারা ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেন, তারা তো নাগরিকই। এমন কোন কাগজ আছে যা প্রধানমন্ত্রী কাছে বাড়তি আছে আমাদের কাছে নেই? ভোটের আগে রুটি কাপড়া ও মকান থেকে নজর ঘোরাতেই এমন বাজার গরম করা কথাবার্তা। শান্তনু ঠাকুর সই আবার কী! ভোটের আগে সম্পূর্ণ পাগলের প্রলাপ।’ ওয়াকিবহাল মহলের ধারনা যেহেতু পঞ্চায়েত নির্বাচনে বনগাঁ মহকুমা এবং রানাঘাট ও কল্যাণী মহকুমা জুড়ে বিজেপির ফল খারাপ হয়েছে, যা মূলত শান্তনু ঠাকুরের নির্বাচনী এলাকার মধ্যেই পড়ে, তাই অনেকেই মনে করছেন ২৪’র ভোটে হেরে যাবেন শান্তনু। সেই লক্ষ্যেই যাতে মতুয়ারা বিজেপি ও শান্তনুর পাশে থাকেন তার জন্যই বেশ সুকৌশলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফের মতুয়াগড়ের বাতাসে CAA তাস খেলেছেন।