নিজস্ব প্রতিনিধি: শীত বেশ জমিয়ে পড়েছে। সামনেই বড় দিন ও বর্ষবরণের উৎসব। এই সময়টাই তো ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময়। এই সময় কী আপনার হাতে সময় একটু কম? অথচ মনটা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য হাঁকপাক করছে? আপনাদের জন্য় আজ বলি নবাবের শহরের গল্প। এই গল্প কিছুটা ভালো লাগার, আর কিছুটা মন খারাপ করার। অল্প সময়ে কলকাতার কাছেই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সেরা ঠিকানা মুর্শিদাবাদ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার শহর। বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত মীরজাফরের শহর।
মুর্শিদাবাদকে ঘিরে অসংখ্য ইতিহাস। ভাগীরথীর তীরে নবাবের শহর সেই প্রাচীন কালেই শিল্প ও সংস্কৃতিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। আজ যা পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। নবাব মুর্শিদকুলি খানের আমলে সেই ১৭২৭ সালে বাংলার এই প্রান্তে শহরটির পত্তন করেন। তাঁর নামেই শহরের নাম হয় মুর্শিদাবাদ। প্রায় ৭০ বছর ধরে এটি মুঘল সাম্রাজ্যের বঙ্গ সুবাহের রাজধানী ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশার কিছু অংশের আওতাধীন এই অঞ্চল। সেসময় বাংলা ছিল সবচেয়ে ধনী মুঘল প্রদেশ। ইতিহাস বলে সেই ১৭৫০ সাল নাগাদ এই শহরের জনসংখ্যা ৭ লক্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কতটা সমৃদ্ধ ছিল মুর্শিদাবাদ। ১৯৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর এই মুর্শিদাবাদ ইংরেজ শাসকদের কাছে লন্ডনের মতোই বিবেচিত হতো।
অতীতে মুর্শিদাবাদের নাম ছিল মুকসুদাবাদ। সপ্তাহে একটা দিন এখানে কাটাতেই পারেন। আবার কলকাতা থেকে দিনের দিন ঘুরে আসা যায়। মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নামতেই পাবেন টোটো স্ট্যান্ড। একটি দরদাম করে ভাড়া করে ঘিরে নিতে পারেন দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি। মুর্শিদাবাদে প্রথমেই যে নাম টা মনে পড়ে তা হল হাজারদুয়ারী। তবে ইতিহাসের এই শহরে দেখার জন্য জাহানকোষা কামান, কাঠগোলা বাগানবাড়ি, জগৎ শেঠের বাড়ি, কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, ফুটি মসজিদ, মীরজাফরের সমাধি ও ভাগীরথীর তীরে ঘণ্টাঘর। এগুলি একদিনেই দেখে নিতে পারেন। আর যদি আরও একদিন মুর্শিদাবাদে থাকেন, তবে ভাগীরথীর অপর পাড়ে দেখে আসতে পারেন খোসবাগ, যেখানে দেখবেন নবাব সিরাজদৌল্লা-সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সমাধি।
হাজারদুয়ারী প্রাসাদ
ভাগীরথীর তীরে এই শহরেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এই প্রাসাদ। ত্রিতলবিশিষ্ট এই প্রাসের ১০০০টি দরজা রয়েছে। তাই এর নাম হাজারদুয়ারী। তবে এরমধ্যে ৯০০টি দরজা নকল এবং ১০০টি আসল। প্রায় ৪১ একর জায়গা জুড়ে এই বিশাল প্রাসাদ তৈরি হয়েছে। নবাব হুমায়ুন জংয়ের আমলে ১৮২৯-১৮৩৭ সালের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। প্রাসাদের চারদিকে বিশাল বিশাল থাম তৈরি এই প্রাসাদ। মোট থামের সংখ্য়া ৫২টি। এক হাজার দরজা বিশিষ্ট এই প্রাসাদে ঘরের সংখ্যাও শতাধিক। ১৯৭৭ সাল থেকে এটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে। বর্তমানে এটি দারুণ এক মিউজিয়াম। সামান্য মূল্যের টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন মিউজিয়ামে। সেকালের নবাবদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং তাঁদের ব্য়বহার্য সামগ্রীর আশ্চর্য সব সংগ্রহ দেখতে দেখতে আপনিও হারিয়ে যাবেন সেই নবাবি আমলে। ভিতরে দেখবেন এক আস্ত কুমিরের মমিকৃত দেহ। হাজারদুয়ারির ভেতরে আরেকটা আকর্ষণীয় জিনিস হল সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১ বাতির একটা সুদৃশ্য ঝাড়লন্ঠন। ঘণ্টাখানেক সময় লাগে মিউজিয়াম দেখতে। বাইরে দেখুন ঘণ্টাঘর, ইমামবাড়া মসজিদ। এরপর টোটো করে অন্য দষ্টব্যে বেরিয়ে পড়ুন। আবার সমস্ত ঘুরে এসে শেষেও দেখে নিতে পারেন হাজারদুয়ারী। মনে রাখবেন হাজারদুয়ারি শুক্রবার বন্ধ থাকে।
ইমামবাড়া ও বাচ্চাওয়ালি কামান
হাজারদুয়ারীর ঠিক বিপরীত দিকেই অবস্থিত ইমামবাড়া। সাদা ও সবুজ রঙের সুবিশাল এক প্রাসাদ। সারা বছরই বন্ধ থাকে এটি, শুধুমাত্র মহরমের সময় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য খুলে দেওয়া হয় ইমামবাড়া। এই সময় এখানে বড় মেলা হয়। দুই প্রাসাদের মাঝেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ঘড়ি মিনার। কথিত আছে এই ঘড়ি মিনারের বড় ঘড়িগুলির ঘণ্টার আওয়াজে একসময় গোটা মুর্শিদাবাদের মানুষ সময় জানতে পারতেন। হাজারদুয়ারীর প্রবেশ পথের এক পাশে এক বাধানো বেদিতে একটা বড় কামান রয়েছে। এরই নাম হল বাচ্চাওয়ালি কামান। জানা যায় সেই ১৬৮৭ সালে এই কামান তৈরি হয়েছিল। পরে নদী থেকে এটি উদ্ধার হয়েছিল। এর দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট এবং ওজন সাড়ে ৬ হাজার কেজির বেশি। জানা যায়, একবারই এই কামান দাগা হয়েছিল। আর এর প্রচণ্ড শব্দে মুর্শিদাবাদের ১০ কিমি পর্যন্ত এলাকা কেঁপে উঠেছিল। সেই শব্দের তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে বহু সন্তানসম্ভবা বধূর গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল বা গর্ভের সন্তান মারা গিয়েছিল। সেই থেকেই এই কামানের নাম বাচ্চাওয়ালি কামান।
আরও অনেক দ্রষ্টব্য আছে। যেগুলি সম্পর্কে পরের পর্বে জানাবো আপনাদের।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন?
কলকাতা ও শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেশ কয়েকটি প্যাসেঞ্জার ও এক্সপ্রেস ট্রেন মুর্শিদাবাদ যায়। লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরেও যেতে পারেন। তবে পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে ভালো ট্রেন হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস। ১৩১১৩ হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস প্রতিদিন সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে ৭.১৯ মিনিটে ব্যারাকপুর ও ৮.১৮ মিনিটে রানাঘাট স্টেশন হয়ে মুর্শিদাবাদ পৌঁছয় সাড়ে ১০টা নাগাদ। ফেরার পথেও এই ট্রেনটি প্রতিদিন বিকেল ৪.৪৪ মিনিটে মুর্শিদাবাদ থেকে ছেড়ে রানাঘাট ব্যারাকপুর হয়ে কলকাতা স্টেশন পৌঁছয় রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ। এছাড়া ধর্মতলা ও বাবুঘাট থেকে প্রচুর সরকারি ও বেসরকারি বাস যায় মুর্শিদাবাদে। সারাদিনের জন্য় টোটো ভাড়া মোটামুটি ৬০০-৭০০ টাকা মতো পড়ে।
থাকার জন্য মুর্শিদাবাদে বহু হোটেল রয়েছে। মোটামুটি ৮০০-১৫০০ টাকার মধ্যে বহু হোটেল পাবেন। তবে সোম থেকে শুক্র একটু কম রেটে ঘর পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদে। শনি ও রবি বা ছুটির দিনে হোটেলের রেট একটু বেড়ে যায়। এরমধ্যে হোটেল ইন্দ্রজিৎ, হোটেল সাগ্নিক, হোটেল মঞ্জুসা অন্যতম। আবার মুর্শিদাবাদে ইউথ হোস্টেলেও থাকতে পারেন।