এই মুহূর্তে




কোন দর্জির থেকে বালিশ নিয়েছিলেন মহাপ্রভু জগন্নাথ? জানুন অজানা কাহিনি




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : মহাপ্রভু শ্রী জগন্নাথ অপার করুণাময়। তিনি লীলা পুরুষোত্তম। তাঁর হাত পা না থাকতেও সবই আছে। তিনি আদি, তিনি অনন্ত, তিনি অসীম। শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে তাঁর রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘অপাণিপাদো জখনো গ্রহীতা’, অর্থাৎ,তাঁর হাত নেই, কিন্তু তিনি গ্রহণ করেন। তাঁর পা নেই, কিন্তু তিনি গমনে দ্রুতগতিসম্পন্ন। ‘পশ্যত্যচক্ষুঃ স শূণোত্যকর্ণঃ’ অর্থাৎ, তিনি চক্ষুকর্ণ রহিত হয়েও দর্শন ও শ্রবণে সক্ষম। ‘স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা’। অর্থাৎ, কেউ তাঁকে কিচ্ছুটি না জানালেও তাঁর সবই জানা। কারণ, ‘তমাহুং পুরুষং মহান্তম্’। তিনিই পুরুষোত্তম। তিনি সমগ্র জগতের নাথ জগন্নাথ। জানা যায়, তিনি তাঁর ভক্তদের বহুবার বহুস্থানে দেখা দিয়েছেন, এমনকি বিপদের থেকে উদ্ধার করেছেন। ভক্তের ডাক উপেক্ষা করে থাকতে পারেননা তিনি। এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল পরমেষ্ঠী দর্জির জীবনে। যা যুগ যুগ ধরে মহাপ্রভু ভক্তদের চোখে জল এনে চলেছে।

ভারতে তখন মুসলমান শাসন চলছে। দিল্লির বুকে বসবাস করতেন এক সাধারণ দর্জি, নাম তাঁর পরমেষ্ঠী। পিঠে কুঁজ আর অস্বাভাবিক চেহারা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। দেখতেও খুব একটা ভাল ছিলেন না। কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল অত্যন্ত শুদ্ধতায় ভরা। শ্রীবিষ্ণুর প্রতি তাঁর ভক্তি ছিল অটল, আর তার পাশাপাশি পরমেষ্ঠী কাজে ছিলেন অসাধারণ দক্ষ। এমনই নিখুঁত ছিল তাঁর সেলাইয়ের কাজ যে, দিল্লির বাদশাহও নিজের পোশাক-গৃহসজ্জার জিনিস তৈরির জন্য কাপড় পাঠাতেন তাঁর কাছে।

জনশ্রুতি অনুসারে, একবার দিল্লির বাদশাহ পরমেষ্ঠীর কাছে মূল্যবান মণিমুক্তো খচিত সোনার সুতোয় নকশা করা কাপড় পাঠিয়েছিলেন । তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, সেই কাপড় দিয়ে বাদশাহের জন্য দুটি বালিশ তৈরি করতে হবে। কাপড় হাতে পেয়েই পরমেষ্ঠীর মনে হল, এতো সুন্দর কাপড় মানুষের ব্যবহারের জন্য নয়—এই কাপড়ে তৈরি করা বালিশে মহাপ্রভু জগন্নাথ বিশ্রাম করলে তা অধিক শ্রেয় হবে! আর সামনেই ছিল রথযাত্রা। তিনি ভক্তিভরে দু’টি অসাধারণ বালিশ তৈরি করে ফেললেন, আর তারপরেই ঘটল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা।

দেখতে দেখতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার দিন এসে গেল। শ্রীক্ষেত্রে সেই সময় রথযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। পরমেষ্ঠী হঠাৎ ভাবজগতে গিয়ে বাস্তব আর ভাবনা মিলেমিশে একাকার হয় গেল। পরমেষ্ঠীর চোখের সামনে দেখতে লাগলেন এক অপার্থিব দৃশ্য—মনে হল তিনি শ্রীক্ষেত্রের রাজপথে হাতে একটি বালিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রথযাত্রায় মহাপ্রভু শ্রী জগন্নাথ ‘পহান্ডি বিজে’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছেন, পান্ডারা তাঁকে বালিশের উপর শুইয়ে রথের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ পরমেষ্ঠী দেখলেন, জগন্নাথের একটা বালিশ ফেটে গিয়ে তুলো বেরিয়ে এসেছে। মহাপ্রভু যেন তাঁর কাছেই একটি বালিশ চাইছেন! তখনই ভক্তিভাবে পরমেষ্ঠী একটি বালিশ তুলে ধরে জগন্নাথের পদতলে রেখে দিলেন। জগন্নাথ সেই বালিশে পদার্পণ করে রথের দিকে অগ্রসর হলেন, আর সেই দৃশ্য দেখে পরমেষ্ঠীর মন তৃপ্তিতে ভরে উঠল।

কিন্তু ধ্যানভঙ্গ হতেই তিনি দেখলেন, তিনি নিজের ঘরেই বসে আছেন! আর তাঁর তৈরি দুটি বালিশের একটি পড়ে আছে, আরেকটি নেই! তখনই পরমেষ্ঠীর মনে হল, তাঁর বালিশ সত্যি সত্যিই জগন্নাথ গ্রহণ করেছেন। আনন্দ আর বিস্ময়ে কেঁদে উঠলেন তিনি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ও তাঁকে আচ্ছন্ন করল—বাদশাহকে কী উত্তর দেবেন?

কিছুক্ষণের মধ্যে বাদশাহের দূত এসে হাজির হল। বাদশাহ বালিশ দুটি দেখতে চাইছেন। পরমেষ্ঠী একটিমাত্র বালিশ নিয়ে বাদশাহের দরবারে গেলেন। বাদশাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “দু’টি বালিশের বাকিটা কোথায়?” পরমেষ্ঠী অকপটে জবাব দিলেন, “প্রভু জগন্নাথ অন্য বালিশটি গ্রহণ করেছেন।” এবং সবকিছু খুলে বললেন। শুনে বাদশাহ প্রথমে হাসলেন। কোথায় দিল্লি আর কোথায় নীলাচল। তাও কিনা দিল্লি থেকে পুরীতে জগন্নাথ বালিশ গ্রহণ করেছেন! এরপর ক্রুদ্ধ বাদশাহ এই দৈব ঘটনা বিশ্বাস না করে প্রহরীকে আদেশ দিলেন পরমেষ্ঠীকে বন্দি করে কারাগারে পাঠানোর জন্য। শিকলে বেঁধে পরমেষ্ঠীকে তিলে তিলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হল।

কারাগারে বসে পরমেষ্ঠী প্রাণভরে জগন্নাথের নাম জপতে লাগলেন। তখন গভীর রাত। ভক্তের ডাকে কারাগারে আবির্ভুত হলেন জগন্নাথ।  কারাগারের অন্ধকারে হঠাৎ উদ্ভাসিত হল এক দ্যুতিময় আলো এবং সেই আলোয় আবির্ভূত হলেন তিনি—গায়ের রং ঠিক বর্ষার মেঘের মতো কৃষ্ণ, চোখে অপার করুণা আর মুখে মধুর হাসি। তিনি তাঁর শ্রীচরণ রাখলেন পরমেষ্ঠীর মাথায়। মুহূর্তেই পরমেষ্ঠীর কুঁজ অদৃশ্য হয়ে গেল, আর তাঁর চেহারা সৌন্দর্যের দীপ্তিতে ঝলমল করতে লাগল।

অন্যদিকে, ঠিক সেই রাতেই বাদশাহ ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলেন। এক বিশালকায় মূর্তি, চোখে আগুনের শিখা, তাঁর ওপর প্রহার করছেন রুদ্ররূপী মহাপ্রভু আর বলছেন, “পরমেষ্ঠী আমার ভক্ত, তাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? এখনই যদি তাকে মুক্ত না কর, তোমার ধ্বংস অনিবার্য।” আতঙ্কিত অবস্থায় ঘুম ভেঙে বাদশাহ দেখলেন তাঁর শরীরজুড়ে প্রহারের দাগ ও অসহ্য বেদনা।

সকাল হতেই কোনও ক্রমে তিনি ছুটে এলেন কারাগারে। পরমেষ্ঠীকে দেখে স্তম্ভিত হলেন—কুঁজহীন, মনোহর রূপে দীপ্তিমান পরমেষ্ঠী হরিস্মরণে মগ্ন। বাদশাহ নিজেই তাঁকে আলিঙ্গন করে ক্ষমা চাইলেন, শ্রীজগন্নাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন এবং প্রচুর উপহার দিয়ে তাঁকে মুক্তি দিলেন।

এভাবেই ভক্তি, নিষ্ঠা আর প্রভুর করুণায় অসাধ্য সাধন হয়েছিল এক দর্জি পরমেষ্ঠীর জীবনে, আর এই ঘটনা আজও ভক্তদের মনে ভগবানের অপরিসীম দয়া ও মহিমার অনন্ত উদাহরণ হিসেবে জাগ্রত। জগন্নাথ স্বামী নয়নপথ গামী ভবতু মে ।।

Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

লুকানো হৃদরোগ শনাক্তে কার্ডিওলজিস্টদের চেয়েও নির্ভুল এই নতুন AI টুল

জানেন কী, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একমাত্র এই কৌরব যুদ্ধ করেছিলেন পাণ্ডবদের হয়ে?

জানেন, কেন লক্ষ্মীদেবী সবসময় ভগবান নারায়ণের পায়ের কাছে বসেন?

মাত্র আড়াই বছরে বাজিমাত পায়রাডাঙার শ্রেয়ানের, নাম উঠল ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে

নজিরবিহীন! ১২ বছরের নাবালকের কথা শুনে নিজের ভুল স্বীকার করে রায় বদলাল সুপ্রিম কোর্ট

‘এখনও মনে আছে সেই সব রাত…’’, মেয়ে আয়রার জন্মদিনে আবেগপ্রবণ শামি

Advertisement
এক ঝলকে
Advertisement

জেলা ভিত্তিক সংবাদ