এই মুহূর্তে




মুসলিম ভক্ত সালবেগের জন্য সাতদিন থমকে দাঁড়িয়েছিল জগন্নাথের রথ




পৃথ্বীজিৎ চট্টোপাধ্যায় : লীলাপুরুষোত্তম শ্রী জগন্নাথ ভক্তের ভগবান। ভক্তের অশ্রু দেখলে তিনিও স্থির থাকতে পারেননা। তাঁর কাছে উচ্চ-নিচ, ধনী-দরিদ্র, ধর্মী-বিধর্মী নির্বিশেষে সকল ভক্তই এক। জানা যায়, তাঁর পরম ভক্ত সালবেগ ছিলেন বিধর্মী, যাঁর মা দরিদ্র ব্রাহ্মণের বিধবা হলেও বাবা বলবেগ ছিলেন একজন মুসলমান সেনাপতি। সালবেগ তাঁর মায়ের আদর্শে বড় হওয়ায় ছোট থেকেই জগন্নাথ দেবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তাঁর কাহিনি এক অনন্য ভক্তির নিদর্শন , যা যুগ যুগ ধরে ভক্তিমতীদের হৃদয়ে প্রেরণা জুগিয়ে আসছে। জগন্নাথদেবের প্রতি তাঁর অপরিসীম প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছিলেন জগন্নাথদেব কেবল জাতপাত, ধর্মবর্ণে বিশ্বাসী নন; তিনি সর্বজনীন ভগবান, যিনি তাঁর ভক্তের অন্তরের গভীরতা বোঝেন।

জানা যায়, সালবেগ একাধিক বার মহাপ্রভুর শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করতে চাইলেও তিনি বিধর্মী হওয়ার হেতু তাঁকে মন্দিরে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি জানতেন, একমাত্র রথযাত্রার দিন প্রভু জগন্নাথ মন্দিরের গণ্ডি ছেড়ে বাইরে আসেন এবং তখনই সকলকে অবারিতভাবে কৃপাদৃষ্টি দেন। সেই আশায় তিনি পুরীর কাছাকাছি বলগণ্ডি নামে এক স্থানে পথের ধারে কুটির তৈরি করে থাকতে শুরু করলেন। প্রতিবছর রথযাত্রার সময় তিনি সেখান থেকে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপভোগ করতেন, প্রাণ ভরে দর্শন নিতেন। আর বাকি সময়টা তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়িয়ে, ভজন-সাধনায় কাটাতেন।

কিন্তু একবার সালবেগ বৃন্দাবনে অবস্থানকালে জানতে পারলেন, রথযাত্রার সময় আসন্ন। প্রাণে পুলক জেগে উঠল, আর দেরি না করে তিনি পুরীর উদ্দেশে যাত্রা করলেন। কিন্তু পথেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, শরীর ভেঙে পড়ল ক্লান্তিতে। মনে হতে লাগল, এ বছর বোধহয় রথযাত্রায় প্রিয়প্রভুর দর্শন হবে না। বুক ফেটে কান্না এল তাঁর, চোখের জলে প্রার্থনা জানালেন- “প্রভু, আমার জন্য একটু অপেক্ষা করো। আমায় দেখা না দিয়ে চলে যেও না!”

এদিকে দেখতে দেখতে রথযাত্রা পেরিয়ে উল্টোরথের দিন এসে গিয়েছে। মহাপ্রভু তাঁর নন্দীঘোষ রথে চড়ে গুণ্ডিচা মন্দির থেকে শ্রীমন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। লক্ষ লক্ষ ভক্ত রথ টানছেন, রথ এগোচ্ছে রাজপথে। চারিদিকে  ‘জয় জগন্নাথ, জয় জগন্নাথ’ ধ্বনিতে মুখরিত। কিন্তু, হঠাৎ পথে থমকে গেল রথ। শ’য়ে শ’য়ে ভক্ত দড়ি ধরে টানছেন, হাতির সাহায্য নেওয়া হল, তবুও এক চুলও নড়ছে না রথের চাকা। জনসমুদ্রের মাঝে বিস্ময়ের সঞ্চার হল। কেন এই ছন্দপতন? প্রায় সাতদিন ধরে রথ স্থির হয়ে রইল, রথেই চলল জগন্নাথের আরতি, পুজো, ভোগ নিবেদন। কিন্তু মহাপ্রভু মন্দিরে ফিরবেন কীভাবে?

ঠিক সেই সময় দূর থেকে ভেসে এল ভক্তিভরা কণ্ঠস্বরে এক সুমধুর গান –

“জগবন্ধু হে গোঁসাই, তুম্বা – শ্রীচরণ বিনু অন্য গতি নাহি।”

লোকজন দেখতে পেলেন, গান গাইতে গাইতে আসছেন সালবেগ। ক্লান্ত-অসুস্থ দেহ টেনে তিনি এগিয়ে আসছেন। অবশেষে নন্দীঘোষের সামনে এসে দাঁড়ালেন, দু’চোখ ভরে প্রাণেশ্বর জগন্নাথকে দেখলেন। আনন্দাশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে বুক, কাঁপছে ঠোঁট, আর প্রভু জগন্নাথও বিস্ফারিত নয়নে তাঁকে দেখছেন, মুখে লেগে আছে মধুর হাসি।

ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার গড়াতে শুরু করল রথের চাকা! হাজার হাজার ভক্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। বুঝতে বাকি রইল না, প্রভু জগন্নাথ তাঁর প্রিয়ভক্ত সালবেগের জন্যই এই সাতদিন স্থির হয়ে অপেক্ষা করেছিলেন, যাতে সালবেগ এসে তাঁর দর্শন পেতে পারেন। এর চেয়ে বড় ভক্তপ্রেম আর কী হতে পারে! ভক্ত সালবেগ তাঁর প্রিয় ভগবানকে দেখে সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করলেন। তাঁর আত্মা বিলীন হয়ে গেল মহাপ্রভুর শ্রীচরণে।

সালবেগ ছিলেন এক অমর ভজনকবি। তিনি প্রায় দেড়শোরও বেশি ভজন রচনা করেছেন, যার মধ্যে ‘আহে নীল শৈল’ ভজনটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর প্রতিটি ভজনেই ফুটে উঠেছে ভক্তির গভীরতা, জগন্নাথপ্রেমের উচ্ছ্বাস। ভক্তির নিরিখে বর্ণাশ্রম বা জাত-পাত যে কোনো বাধা নয়, সালবেগের জীবন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখনও প্রতি বছর রথযাত্রার সময় জগন্নাথদেবের রথ সালবেগের সমাধির সামনে এসে থেমে যায়। হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে বেঁচে ওঠে সেই ইতিহাস বা কিংবদন্তি, যেন সাক্ষাৎ প্রমাণিত হয় ভগবানের আশ্বাসবাণী –

“যে ভক্ত যেভাবে আমার ভজনা করেন, আমিও তাঁকে সেভাবেই ভজনা করি।”

সালবেগের কাহিনি কেবল এক নিখাদ ভক্তির গল্প নয়, এটি আমাদের শেখায় ভক্তি কখনও জাত, ধর্ম বা সামাজিক অবস্থার কাছে সীমাবদ্ধ নয়। সত্যিকারের ভক্তির কাছে প্রভু সবসময় সাড়া দেন। সালবেগের জীবনের মাধ্যমে আমরা শিখি, ভক্তি যখন নিঃস্বার্থ এবং আন্তরিক হয়, তখন ভগবানও ভক্তের জন্য সমস্ত নিয়মকানুন ভেঙে তাঁর কাছে ধরা দেন। এই কাহিনি যুগে যুগে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঈশ্বরের কাছে মানবমনের পবিত্রতা আর ভালোবাসার কোনও বিকল্প নেই। জয় জগন্নাথ।

Published by:

Ei Muhurte

Share Link:

More Releted News:

গুগলে ৫৪ লক্ষের বেতনে যোগ দিলেন জলপাইগুড়ির শ্রেয়া, গল্প শুনলে চোখে জল আসবে

লুকানো হৃদরোগ শনাক্তে কার্ডিওলজিস্টদের চেয়েও নির্ভুল এই নতুন AI টুল

জানেন কী, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একমাত্র এই কৌরব যুদ্ধ করেছিলেন পাণ্ডবদের হয়ে?

জানেন, কেন লক্ষ্মীদেবী সবসময় ভগবান নারায়ণের পায়ের কাছে বসেন?

মাত্র আড়াই বছরে বাজিমাত পায়রাডাঙার শ্রেয়ানের, নাম উঠল ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে

নজিরবিহীন! ১২ বছরের নাবালকের কথা শুনে নিজের ভুল স্বীকার করে রায় বদলাল সুপ্রিম কোর্ট

Advertisement
এক ঝলকে
Advertisement

জেলা ভিত্তিক সংবাদ