নিজস্ব প্রতিনিধি: মানুষের কর্মকাণ্ডে নয়, দশমীর রাতে উত্তরবঙ্গের(North Bengal) মাল নদীতে(Mal River) হড়পা বানের(Flash Flood) নেপথ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক কারণ। স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে এমনটাই মনে করছেন। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার(GIS) অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর শিখেন্দ্রকিশোর দে মনে করছেন মাল শহরের পাশে মাল নদীতে যেখানে হড়পা বানে ৮জনের ভেসে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেখান থেকে ১৫কিমি উত্তরে মাল নদীর অববাহিকা অঞ্চলে এক জায়গায় ভাঙনের ভগ্নাবশেষ জমে ‘ডেবরিস ব্লকেজ’(Debris Blockage) তৈরি হয়েছিল। তা আদতে একটি বাঁধের রূপ নেয়। ওই বাঁধের একদিকে প্রচুর পরিমাণে জল জমেছিল। সেই জলের চাপে নুড়ি, পাথরের বাঁধ ভেঙে বিপুল জলস্রোত হুড়মুড়িয়ে নেমে এসে এই বিপর্যয় ঘটিয়েছে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অতিথি অধ্যাপকরূপে থাকা শিখেন্দ্রবাবু জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগের উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে ডেবরিস ব্লকেজটি চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পর সেখানকার পরিস্থিতি কী ছিল, তা যাচাই করতে স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া পরবর্তী সময়ের ছবি বিশ্লেষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান স্পেস কমিশনের পাঠানো ‘সেন্টিনেল-২’ উপগ্রহের পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আগামী ১৫-১৬ অক্টোবর নাগাদ স্যাটেলাইটটি ফের ওই জায়গার ছবি নেবে। ওই সময় সেখানকার আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে পরিষ্কার ছবি পাওয়া যাবে। বিশ্লেষণের কাজে যুক্ত আছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রিমোট সেন্সিং বিভাগের গবেষক বিজয়কৃষ্ণ গায়েনও। তিনি জানিয়েছেন, ১০ অক্টোবর ওই জায়গার উপগ্রহ ছবি পাওয়া গেলেও মেঘ থাকার জন্য ভালোভাবে কিছু বোঝা যায়নি। তাই পরবর্তী ছবির জন্য অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। এর পাশাপাশি ওই বিপর্যয়ের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেলেও এর সঠিক কারণ নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেনি রাজ্য বা জেলা প্রশাসনও। তবে রাজ্যের সেচদফতর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
ঘটনার দিন বিসর্জনের জন্য দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই নদীতে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল স্থানীয় পুরসভার উদ্যোগে। ওই বাঁধের কারণেই এই বিপর্যয় বলে অভিযোগ করা হচ্ছে কোনও কোনও মহল থেকে। কিন্তু সঠিক কারণ নিয়ে কেউ এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি এলাকার নদীতে হড়পা বানের আশঙ্কা থাকে। কিন্তু আবহাওয়া দফতর ও স্থানীয় প্রশাসনের রিপোর্টে মাল নদীর অববাহিকা এলাকায় ওই সময় প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার কোনও তথ্য নেই। ফলে আচমকা মাল নদীতে এত জল কীভাবে এল, তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছিল যা এবার বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টে কেটে গিয়েছে। শিখেন্দ্রবাবুর দাবি, ২-৪ অক্টোবর পর্যন্ত মাল নদীর অববাহিকা এলাকায় যে মেঘ ছিল, তাতে খুব বেশি বৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। আর ৫ তারিখ আকাশ আংশিক মেঘাচ্ছন্ন ছিল। ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা ছিলই না। ফলে আচমকা প্রচুর বৃষ্টির তত্ত্ব খাটছে না। পাশাপাশি, ওই ব্লকেজের একদিকে প্রচুর জল এবং অন্যদিকে প্রায় জলশূন্য পরিস্থিতি স্যাটেলাইট ছবি থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
মালের ঘটনার পরে উত্তরবঙ্গের নদীগুলি নিয়ে সতর্ক হয়েছে রাজ্য প্রশাসনও। উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি নদীগুলির জায়গায় জায়গায় নাব্যতা কমে গিয়েছে। বোল্ডার, বালি জমে জমে নদীর গতিপথও বদলে গিয়েছে অনেক জায়গায়। ভাঙছে নদীপাড়। পাশাপাশি বন্যপ্রাণীরা জঙ্গল থেকে অবাধে নদী পার হতে পারছে না। নদীর মাঝে স্তুপীকৃত বোল্ডার, পাথর জমে থাকায় হাতি, চিতা, গণ্ডার সহ আরও বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ব্যাহত হচ্ছে। এবার তাই বন্যপ্রাণী ও বনভূমি সুরক্ষিত রাখতে মহানন্দা অভয়ারণ্য লাগোয়া নদীর নাব্যতা বাড়ানোয় ড্রেজিং করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য বনদফতর। সোমবার রাজ্য বনদফতরের পদস্থ অফিসারদের নিয়ে মহানন্দা নদীবক্ষ পরিদর্শন করেন রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মুখ্য বনপাল সৌমিত্র দাশগুপ্ত, রাজ্য জু অথরিটির সদস্য সচিব সৌরভ চৌধুরী, উত্তরবঙ্গের মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) রাজেন্দ্র জাখর, দার্জিলিংয়ের জেলাশাসক এস পন্নমবালম এবং মাটিগাড়ার বিডিও শ্রীবাস বিশ্বাস। সেই পরিদর্শন শেষে বৈঠকে বসে বনমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন যত দ্রুত সম্ভব মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্যে থাকা প্রায় ৪ কিলোমটিার নদীপথে ড্রেজিং করা হবে। এর জন্য বনদফতরের সঙ্গে দার্জিলিংয়ের জেলাশাসককেও ওই কাজ দ্রুত করার নির্দেশ দেন তিনি।
মহানন্দা অভয়ারণ্যের গুলমা এলাকায় মহানন্দা নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে দু’ধারে নতুন গতিপথে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীর মাঝখানে অর্থাৎ মূল গতিপথ ওলটানো কড়াইয়ের আকার নিয়েছে। গুলমা রেল স্টেশনের কাছে মহানন্দা নদীর প্রায় চার কিলোমটিার গতিপথ তাই ড্রেজিং করা দরকার। তা না হলে নতুন দু’টি গতিপথ তৈরি হবে মহানন্দায়। এতে বন ও বনভূমি নদীর গ্রাসে চলে যাবে, বন্য জন্তুদের সমস্যা হবে, পাশাপাশি লাগোয়া বিস্তীর্ণ বসতি এলাকাতেও ভয়ঙ্কর বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বনের মধ্যে যত নদী আছে সব ক্ষেত্রেই বোল্ডার, বেড মেটিরিয়াল, নদীর নাব্যতা কমে গিয়েছে। মহানন্দা নদীরও উৎস থেকে ১৬-১৭ কিমি নীচে গুলমার কাছে ৪ কিলোমিটার এলাকায় বহু বোল্ডার জমে রয়েছে। এতে নাব্যতা কমে যাওয়ায় পাড় ভাঙছে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ড্রেজিং করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। এর আগে তোর্সা, রায়ডাক নদীতেও একই কারণে ড্রেজিং করা হয়েছে। ২০০৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ অনুযায়ী চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেনের তত্ত্বাবধানে এই কাজ করতে কোনও আইনি সমস্যা নেই। যে এলাকায় ড্রেজিং হবে সেখানকার জেলাশাসক গোটা বিষয়টি দেখবেন।